What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ‘‘রক্তাক্ত বাংলা’’ (1 Viewer)

Pegasus

Member
Joined
Mar 8, 2018
Threads
103
Messages
171
Credits
28,977
উঠোনে পাতানো জলচৌকিতে বসে কথা বলতে থাকা লোকটির দিকে বার বার ফিরে তাকাচ্ছে রাবেয়া। লোকটির সাথে অনেকদিন আগেই বিয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত হয়ে আছে; কিন্তু এলাকার পরিস্থিতি তেমন সুবিধার নয় বলে বিয়েটা এখনো আটকে আছে। গ্রামের মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে রাবেয়া। সেই ছোটবেলা তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে মাস্টারমশাই নিজেই কোলে-পিঠে করে বড় করেছে রাবেয়াকে। মায়ের অভাব তাকে কখনো বুঝতেই দেয়নি সে।
.
রাবেয়া পানির পাত্রটা জলচৌকির এক কোণে রেখে আবারো ঘরের ভেতর চলে গেল। অতঃপর ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। প্রথম যেদিন লোকটির সাথে কথা হয়েছিল সেদিন মনের ভেতর কেমন একটা লজ্জা কাজ করছিল তার। কিন্তু এই ক'দিনের কথা-বার্তার পর সে নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়ছে। তবুও লোকটির চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে তার ভেতরটায়। হয়তো এরকম অনুভূতি কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রত্যেকটা নারীর জীবনেই আসে। ঠিক যেন রাবেয়ার জীবনেও এসেছে সেই সময়টা! সেও মনে মনে একটা ছোট্ট সুখের স্বর্গ সাজিয়েছে অচেনা অজানা ওই লোকটাকে ঘিরে। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়, শিক্ষিতও বটে! রাবেয়ারও ভালো লেগেছে তাকে। হয়তো এজন্যই মাস্টারমশাই তার মেয়েকে এই লোকটির সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। তাছাড়া অনেক বয়স হয়েছে মাস্টারমশাইয়ের। কখন কী হয়ে যায় তা বলা মুশকিল। তাই তো শুভ কাজটা খুব শীঘ্রই সেরে ফেলতে চেয়েছিল সে। কিন্তু দেশের যা অবস্থা তাতে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং দিন যতই এগোচ্ছে ততই যেন পিছিয়ে যাচ্ছে বিবাহের এই অসম্পূর্ণ কাজটা।
হঠাৎ মাস্টারমশাই রাবেয়াকে কাছে ডাকলেন। অতঃপর রাবেয়া কাছে আসতেই সে বলল,
- মা তোরা কথা বল, আমি একটু পুকুরঘাট থেকে ওযু করে আসি...
- আচ্ছা বাবা সাবধানে যেও।
- আচ্ছা মা...
.
মাস্টারমশাই চলে গেলেন। ওই দিকে উঠোনের মাঝে বসে আছে রাবেয়া ও আসাদ। হ্যাঁ তার নাম আসাদ। গ্রীষ্মের শেষ বিকেলে উঠোনের মাঝে মুখোমুখি বসে আছে তারা। রাবেয়া মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে তার সামনে। আসাদের পরিবারে তেমন কেউ নেই। আসাদ শহর থেকে পড়ালেখা করে আবারও গ্রামেই ফিরে এসেছে নিজের পৈতৃক ভিটেবাড়িতে। রাবেয়াও অন্য আর দশটা গ্রাম্য মেয়ের মতো নয়। অনেক চঞ্চল, চটপটে আর শিক্ষিতা মেয়ে। এজন্যই খুব সহজে আসাদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে পেরেছে সে। তবুও বিয়ের আগে এভাবে আসাদের সামনে যেতে কেমন যেন লাজুক একটা ভাব কাজ করছিল তার ভেতরে। কিন্তু বিয়ের আগে উভয়ের মধ্যে একটু বুঝাবুঝি ও ভালো-মন্দের একটু আলোচনা হওয়াটা দোষের কিছু নয়। তাই টুকটাক কথা-বার্তার প্রচলন তখন থেকেই শুরু হয় তাদের মধ্যে।
.
সময়টা যদিও সেই একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পূর্ব মুহূর্তের কথা! তখনকার গ্রাম্য মেয়েরা পরপুরুষ দেখলে আঁচলে মুখ লুকিয়ে দ্রুত দৌড়ে পালাতো। কিন্তু সেরকম একটি সময়েও তারা একে অন্যের সাথে সরাসরি কথা বলছে। মূলত তাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছিল এই কথা-বার্তা আর দেখা-সাক্ষাৎ সুযোগটুকু। আসলে দেশের অবস্থা ততটা ভাল নয় বলেই এই বিয়েটা এখনো আটকে আছে। যাইহোক, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আসাদ বলে উঠল,
- বাবা কি কিছু বলছে?
- নাহ তো! কোন ব্যাপারে?
- আমি মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি সেই ব্যাপারে...
.
মুক্তিযুদ্ধের কথাটি শুনেই হঠাৎ কেঁপে উঠলো রাবেয়া। এবার সে মাথা উঁচু করে আসাদের মুখের দিকে তাকালো। আসাদ খেয়াল করল রাবেয়ার চোখ জোড়া কেমন যেন আতঙ্কে ছেয়ে গেছে। ভয়ে যেন হ্রাস করে ফেলছিল রাবেয়াকে। হাসি-খুশি আর লাজুকবরণ মুখটা নিমিষেই কেমন যেন মলিন হয়ে গেল। আসাদ রাবেয়ার হাতে হাত রাখলেন। তাকে অভয় দিয়ে হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
''দেশের যা অবস্থা তাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিয়ে আর কোনো উপায় নেই। তুমি ভয় পেও না। দেখো আমার কিচ্ছু হবে না। শুধু দোয়া করিও যেন দেশকে স্বাধীন করে তবেই ফিরে আসতে পারি! তুমিও খুব সাবধানে থেকো আর বাবার খেয়াল রেখো''।
.
রাবেয়া কোনো কথা বললো না। শুধু মাথাটা উঁচু করে টলমলে চোখজোড়া আসাদের দিকে নিক্ষেপ করলো আর মুষ্টিবদ্ধ হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরলো। আসাদ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এই ইঙ্গিতের মানে কী! কিন্তু তার কিছুই করার নেই, যেতে যে তাকে হবেই! দেশকে যে স্বাধীন করতেই হবে ঐ পাকিস্তানিদের হাত থেকে। তাই আসাদ একদম তৈরি হয়েই এসেছে। চাদরে ঢাকা অস্ত্রটাও সাথে করেই নিয়ে বেরিয়েছে সে। এখানে এসেছে শুধু রাবেয়াকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু আর বেশিক্ষণ হয়তো থাকা যাবে না। কারণ, এলাকায় রাজাকারের প্রভাব বহুগুন বেড়ে গেছে। তারা দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই আসাদ তরিঘরি করে রাবেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিতে লাগলো।
.
নিত্য দিনের মতো রাবেয়াকে আবারো ঘরের ভেতর রেখে বাহির থেকে দরজায় তালা মারা হলো। যেন দরজার দিকে তাকালে কেউ বুঝতে না পারে যে, ভিতরে কোনো মানুষ আছে। হ্যাঁ দেশের অবস্থা ভালো না বলেই মাস্টারমশাই তার মেয়েকে এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে গৃহবন্দি করে লুকিয়ে রাখে। চঞ্চল চটপটে ভরা যৌবনা মেয়েটিকেও থাকতে হয় গৃহবন্দি হয়ে। বলা তো যায় না, গ্রামের অন্য সব যুবতি মেয়েদের মতো হঠাৎ কখন রাজাকারের বদনজর এসে রাবেয়ার উপরেও পরে। আর সাথে সাথেই মিলিটারিরা এসে মেয়ের স্বতীত্বের উপর ঝাপিয়ে পরে। প্রতিটাদিন আর প্রতিটা মুহূর্ত তাকে খুব সতর্ক হয়ে চলতে হয়। রাবেয়াও ঘর থেকে কোথাও বের হয় না রাজাকারদের কুনজরে পরার ভয়ে। এভাবেই গৃহবন্দি হয়ে একের পর এক কেটে যাচ্ছিল রাবেয়ার দিন। তবুও মনের গহীনে আসাদকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন সাজিয়েছে সে। কিন্তু খুব ভয় হয়; আল্লাহ না করুক, যদি কিছু হয়ে যায়? তাহলে তো আশা-ভরসা আর স্বপ্ন সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে তার।
.
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে কাজল কালো চোখ দুটি ভিজে গেল তা আর খেয়াল নেই রাবেয়ার। আজ রাবেয়া খুব সেজেছিল আসাদ আসবে বলে। চোখে কাজল, মাথায় খোপা, হাতে চুড়ি, পড়নে শাড়ি! গলায় মালা আর পায়ে নূপুর! অবশ্য আহাময়ী কোনো সাজ নয়, কিন্তু চেহারায় যেন অন্যরকম এক মায়াবী ছাপ রয়েছে তার। রাবেয়া জানালার কপাট ধরে আসাদের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো। আসাদও জানার বাহিরে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় রাবেয়ার চোখে চোখ রেখে অপলকে তাকিয়ে আছে। আসাদ আবারো জানালার ফাঁক দিয়ে রাবেয়ার একটি হাত নিজের হাতে নিয়ে চেপে ধরলো। কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই উভয়ের চোখ জোড়া যেন ভিজে যাচ্ছিল। হৃদয়টা কেমন যেন হাহাকারের বজ্রকণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠছিলো রাবেয়ার।
.
আসাদেরও ইচ্ছে করছিল না রাবেয়ার তুলতুলে হাতখানা এত শীঘ্রই ছেড়ে দিতে। কিন্তু তার যে আর সময় নেই। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্বেও আস্তে আস্তে রাবেয়ার মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো সে। তারপর আবারও রাবেয়াকে সাবধানে থাকার আহবান জানিয়ে আসাদ এবার চলে যেতে লাগলো। ওই দিকে রাবেয়া এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো আসাদের গমন পথের দিকে। আসাদও চলতি পথে কেন যেন বার বার পিছনে ফিরে রাবেয়ার দিকে তাকাচ্ছিল। ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেল আসাদ। তারপর রাবেয়াও নিত্য দিনের মতো বদ্ধ ঘরের জানালাটাও বন্ধ করে দিল যেন ঘরের ভিতর কোনো মনুষ্যের অস্তিত্ব টের পাওয়া না যায়।
.
সেদিনের মতো এভাবেই কেটে গেল দিনটি। কিন্তু পরের দিন থেকেই চারিদিকে যুদ্ধের সেই ভয়ংকর গোলাগুলির গর্জন আরও তীব্র বেগে গর্জে উঠতে লাগলো। একাত্তরের এই স্বসস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য অসংখ্য বাঙালি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছে। মা-বোনরা হারিয়েছে ইজ্জত। পাকিস্তানি মিলিটারিদের এই হানাহানি-মারামারি একাধারে লেগে ছিল দীর্ঘ নয়টি মাস। যার প্রতিটি মুহূর্তই ছিল চরম ভয়াবহ ও হৃদহর্ষক। চারিদিক কম্পিত হচ্ছে বুকফাটা আর্তনাদে। আপনজন হারানোর বেদনায় হাহাকার করে উঠলো সমস্ত বাঙালি। পিতা হারালো কেউ, সন্তান হারালো কেউ! কেউ বা হারালো স্বতীত্ব। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো বাংলায় স্বাধীনতার স্বার্বভৌমত্ব। ঠিক এমনই এক ভয়াবহ মুহূর্ত রাবেয়ার জীবনেও এসে উপস্থিত হয়। সময়টা ছিল একাত্তরের এক কালো রাতের ঘটনা। যখন তার জীবনের সবকিছু নষ্ট করে দিয়েছিল ওই পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীরা। হারিয়ে যায় সমস্ত স্বপ্ন, আশা, ভরসা সহ জীবনের মূল্যবান সবকিছু।
.
নিত্য দিনের মতো বাহিরে থেকে দরজায় তালা দেওয়া ছিল মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। আর বৃদ্ধ মাস্টারমশাই কখনো উঠোনে পাতানো ছোট জলচৌকিতে আবার কখনো বা বারান্দায় এসে রাত্রিযাপন করতো। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ঠিক উঠোনে এসে গা এলিয়ে দিলো সারাদিনের ক্লান্ত মাস্টারমশাই। কিন্তু মাঝ রাতে হঠাৎ কারো আগমনের শব্দ শুনে তরিঘরি করে ঘুম থেকে উঠলেন তিনি। দেখলেন প্রায় পাঁচ-সাত জন মিলিটারি এসে উঠোনে দাঁড়িয়েছে। সাথে দু'জন দাড়ি-টুপি ওয়ালা রাজাকার সদস্য। তাদের মধ্যে একজন মিলিটারি হঠাৎ মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাস করলেন,
- মাস্টার সাহাব তুমহারা লারকি কাহা হ্যায়?
''মাস্টার মশাই কিছু বলার আগেই অন্য একজন রাজাকার বলে উঠলেন''
- আইয়্যে বাবুজি ইধারছে আইয়্যে, এ ঘরপে মিলেগি ও লারকি...
.
কথাটি বলেই ওই রাজাকার মিলিটারিদেরকে মাস্টারমশাইয়ের ঘরের দরজার কাছে নিয়ে যায়। ওই দিকে মাস্টারমশাই কিছু বুঝে উঠার আগেই দুজন মিলিটারি তাদের অস্ত্রের আঘাতে ঘরের তালা ভাঙতে শুরু করলো। তখন মাস্টারমশাই দৌড়ে এসে মিলিটারিদের পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। কারণ, ওই বাঙালির শত্রু রাজাকাররা মিলিটারিদেরকে আগেই বলে দিয়েছে যে, তার মেয়েকে ঘরের ভিতরে তালা মেরে লুকিয়ে রাখা হয়। তাই মিলিটারিরা বৃদ্ধ মাস্টারমশাইকে সজোড়ে লাথি মেরে উঠোনের উপর ছুরে ফেলে দিলেন।
.
ওই মুহূর্তে মিলিটারিদের মাথায় তীব্রভাবে নারী লালসা কাজ করছিল। তাই দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকেই ঝাপিয়ে পরলো রাবেয়ার ভরা যৌবনা পুষ্টদেহের উপর। তারা একের পর এক চালিয়ে যাচ্ছিল অমানুষিক নির্যাতন। ঠিক ওই মুহূর্তে রাবেয়াও কষ্টে আত্মচিৎকার দিতে লাগলো কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। পাষাণ্ড ওই নরপিচাশেরা শেষ পর্যন্ত রেহাই দেয়নি রাবেয়াকেও। বাহির থেকে মাস্টারমশাইও জোড়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো আর করুণ কণ্ঠে বিলাপ করতে লাগল,
- তোমরা আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও...
.
কিন্তু কে শোনে কার কথা! মাস্টারমশাইয়ের এই বুকফাটা আর্তনাদ কারোই কার্ণপাত হলো না। হঠাৎ একটা গুলির শব্দে মিলিটারিরা চিরদিনের মতো বন্ধ করে দিলো মাস্টারমশাইয়ের এই বুকফাটা আত্মচিৎকার। এখন চারিদিক হয়ে গেলো নিস্তব্ধ। মাস্টারমশাইয়ের রক্তাক্ত মৃতদেহটাকে উঠোনের মাঝে ছুরে ফেলে দিলো তারা। তারপর মনের আয়েশ মিটিয়ে একের পর এক তাদের যৌনক্ষুধা মিটাতে লাগল রাবেয়ার উপর দিয়ে। রাবেয়াও অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। তারও কষ্টের ওই বোবা আর্তনাদ এই নরপিচাশদের কান অবধি পৌঁছলো না। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো রাবেয়া। তবুও হিংস্র প্রাণীর ন্যায় চলছিল তাদের যৌন নিপীড়ন। অতঃপর কোনো রকম দেহের মধ্যে প্রাণটা ঝুলিয়ে রেখে অর্ধনগ্ন রাবেয়াকে বিছানার উপরেই ফেলে রেখে চলে গেল ওই হিংস্র নরপশুর দল।
.
অতঃপর ভোর হলো। গাছেগাছে পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে কুঞ্জন করতে লাগলো। সকালের রুপালী সূর্য উদিত হলো। রাবেয়াও চোখ খুললো। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণায় নিস্তেজ দেহখানা বিছানার উপরেই পড়ে রইলো। ছটফট করতে লাগল সে। এভাবেই সকাল পেরিয়ে দুপুর আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওই দিকে মাস্টারমশাইয়ের মৃত দেহখানা ওভাবেই উঠোনের উপরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রইলো। ঠিক এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আসলো আসাদ। কিন্তু কী লাভ তাতে? উঠোনে পড়ে থাকা রক্তাক্ত মৃতদেহখানি কোলে নিয়ে ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কেঁদে উঠে সে। হঠাৎ মনে পড়ে মাস্টারমশাইয়ের সেই কথাটি, ''বাবা তুমি আমার মেয়েকে দেখে রেখো''। আসাদ দ্রুত ঘরের দিকে দৃষ্টি ফিরালো। পাগলের মতো ছুটে গেল ঘরের দিকে। ঘরের তালা ভাঙা ছিল ঠিকই কিন্তু ভেতর থেকে দরজা লাগানো।
.
আসাদ জানালা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটাও ভেতর থেকে লাগানো। এবার আসাদ জোড়েই চিৎকার দিয়ে উঠলো আর করুণ কণ্ঠে রাবেয়ার নাম ধরে ডাকতে লাগলো। রাবেয়াকে দরজা খুলতে বললো কিন্তু সে খুললো না। শুধু একটি বার রাবেয়ার মুখ্খানি দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো আসাদ। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে হঠাৎ রাবেয়ার কান্নার আওয়াজ ভেসে ওঠে। রাবেয়া কান্না মাখা কণ্ঠেই হঠাৎ চিৎকার দিয়ে আসাদকে বলে উঠল,
- এই কলঙ্কিনী মুখ তোমাকে দেখাতে পারবো না আমি! যদি এই ইজ্জতের বদলা নিতে পারো, যদি এই হত্যার বিচার করতে পারো, যদি এই দেশকে স্বাধীন করতে পারো, তবে সেদিন এসো! আমি দরজা খুলে দেবো। নয়তো আর কোনোদিন এই মুখ দেখতে চেও না...
.
চারিদিকে এত অত্যাচার, এত যন্ত্রণা, এত রক্তপাত! নাহ্ আর সহ্য করতে পারছিলো না আসাদ। তার বুকে ভর করল এক অদম্য শক্তি আর অসীম সাহস। আপনজন হারানোর বেদনা আর চারিদিকে এত রক্তের বন্যা; সবকিছু মিলিয়ে তার মস্তিষ্ক আরও তীব্র বেগে গর্জে উঠল। সে অস্ত্র হাতে ছুটে গেল যুদ্ধের খোলা ময়দানে। স্বসস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে। যাকে বলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ! হ্যাঁ হ্যাঁ এই সেই মুক্তিযুদ্ধ!
.
যে যুদ্ধের কথা পৃথিবীর বুকে চিরস্বরণীয় হয়ে আছে। যে যুদ্ধে লাখো বাঙালি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। মা-বোনরা হারিয়েছে ইজ্জত। রাবেয়ার মতো অসংখ্য যুবতিরা ওই নরপিচাশের হাতে হয়েছে যৌনাচারের স্বীকার। মাস্টারমশাইয়ের মতো লাখো নিরীহ বাঙালি অকারণেই হারিয়েছে প্রাণ। মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে অজস্র মুক্তিসেনা দেশের জন্য হয়েছে শহীদ। এই সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ! এই সেই বেদনা ভরাক্রান্ত সময়! এই সেই সংগ্রাম! এই সেই কৃষক, শ্রমিক ও তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের জাগ্রত জয়োগান! যখন আসাদের মতো যোদ্ধারা দেশের জন্য অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। যারা দীর্ঘ নয় মাস একের পর এক স্বসস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করেছে এদেশের স্বাধীনতার স্বার্বভৌমত্ব। এই সেই বুকফাটা আর্তনাদ! এই সেই কষ্টের হাহাকার! এই সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধো! আর এই সেই রক্তাক্ত বাংলা!
.
দীর্ঘ নয় মাস স্বসস্ত্র যুদ্ধের পর অনেক কষ্টে ফিরে এসেছে এদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু ফিরে এলো না অজস্র মুক্তিসেনা। যারা দেশের জন্য নিজেরদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে তারা আর ফিরে আসবে না, কখনোই না! ঠিক তেমনি আসাদও আর ফিরে এলো না। আসাদও দেশের জন্য হয়েছে শহীদ। হয়তো শহীদ হয়ে আসাদের মতো মুক্তিসেনারা পরোপারের ঠিকানায় খুব সুখেই আছে। কিন্তু রাবেয়ার মতো মেয়েদের জীবনে নেমে এলো চরম দূর্গতি। আজ দেশ স্বাধীন। সবাই যে যার মতো গুছিয়ে নিচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছু। কিন্তু কলঙ্কের দাগ ঘুচলো না রাবেয়ার। সমাজের কাছে রাবেয়া আজ হয়ে উঠেছে ঘৃনিত আর কলঙ্কিনী নারী হিসেবে। কারণ, রাবেয়া একজন অন্তঃসত্বা নারী। তার গর্ভে পাকিস্তানিদের রক্ত। সমাজের বুকে সে এখন ঘৃনার পাত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
.
রাবেয়া অনেক কষ্ট আর ত্যাগের পরেও তার গর্ভের ওই নিষ্পাপ নবজাতককে পৃথিবীর মুখ দেখাতে চেয়েছিল। এজন্য তাকে চরম খেসারত দিতে হয়েছে। সমাজের মানুষের কাছে হয়েছে লাঞ্চনার স্বীকার। হঠাৎ একদিন মাঝ রাতে রাবেয়ার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। নাহ্ সেদিনও কেউ তার পাশে ছিল না। অসহ্য যন্ত্রণা নীরবে দাঁত চেপে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নিয়ে অবশেষে তার কোল জুড়ে আগমন হয় এক নিষ্পাপ নবজাতকের। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এত কষ্টের পরেও অবশেষে রাবেয়ার কোল জুড়ে এলো এক মৃত সন্তান।
.
হায় রে যন্ত্রণা! হায় রে লাঞ্চনা! হায় রে কষ্ট! সব কিছুর যেন পরিসমাপ্তি ঘটলো আজ। গর্ভে থাকা অবস্থায় নিষ্পাপ বাচ্চাটি হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, দুনিয়ার বুকে চিরকাল তাকে পিতৃ পরিচয়হীনভাবে বাঁচতে হবে। তখনকার যন্ত্রণাটা হয়তো আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হতো। আর বাচ্চাটি হয়তো সেই কষ্টের ভার বহন করতে পারবে না, তাই গর্ভেই মরে গিয়েছে। অবশ্য এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। কারণ, পৃথিবীর মানুষেরা তাকে এমনিতেও বাঁচতে দিতো না। প্রতিনিয়ত পিতৃ পরিচয়হীন এক জরোজ সন্তান হিসেবে পরিচয় পেতে হতো তাকে। যা হয়তো এখনকার চেয়ে আরও কোটি গুণ বেশি যন্ত্রণাদায়ক হতো। তাই সে মরে গিয়েই হয়তো বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু ভাবে বাঁচতে পারছে না রাবেয়ার মতো মেয়েরা। এই সমাজ তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। এই সমাজের প্রতিটি মানুষ তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। মানুষের কটুদৃষ্টি আর শত লঞ্চনা প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে রাবেয়াকে।
.
হায় রে মুক্তিযুদ্ধ! হায় রে স্বাধীনতা! এত কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে বাস করেও আজ রাবেয়ার মতো অসংখ্য নারী পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। একদিন যারা স্বপ্ন দেখেছিল একটি ছোট্ট সুখের সংসার সাজানোর, কিন্তু আজ তারাই এই পৃথিবীর বুকে হয়ে গেল অতি জঘন্য ও ঘৃনার পাত্র। তাদেরকেই এদেশের নিষ্ঠুর মানুষেরা প্রতিনিয়ত ঘৃনার বক্রদৃষ্টিতে দেখছে। প্রতিটি মুহূর্ত তাদেরকে চরম অপমান আর লাঞ্চনা নিয়ে বাঁচতে হয়। তবে কি এটাই দেশের স্বাধীনতা? এজন্যই কি দিয়েয়েছিল লাখো প্রাণ বিসর্জন? এটাই কি ছিল তবে এত রক্তক্ষয়ের কারণ? এটাই কি ছিল তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য?
.
জানা নেই! না না এর উত্তর কারো জানা নেই! জাতি আজ বাকরুদ্ধ! আজ তার বলিবার ভাষা নেই, নেই কিছু করিবার সাধ্য। হায়ে রে স্বাধীনতা, আজ তুমি হয়ে আছো অন্ধ।

 

Users who are viewing this thread

Back
Top