একটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যু।
মূল লেখক - ডাঃ আফতাব হোসেন।
ঢং, ঢং, ঢং, ঢং।
কান খাড়া করে গোনে কবির। এক, দুই, তিন, চার। এখনও এক ঘণ্টা বাকি। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে কবিরের। সেই কোন সকালে দুটা শুকনা রুটি খেয়ে এসেছে। ঘণ্টা দুই আগেই তা হজম হয়ে গেছে। সেই থেকে পেটের অলিতে গলিতে ছুঁচোদের আনাগোনা, থেকে থেকে মিছিল, শ্লোগান। ভিক্টোরিয়া ইনফ্যান্ট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বছর দশেক বয়স। ছোটখাটো, শুকনা-পটকা শরীর। বয়সের তুলনায় বেশ ছোটোই দেখায়। তবু এত খিধা লাগে ক্যান? ওর মাথায় আসে না। যদিও অনেকে ছোট্ট প্লাস্টিকের বক্সে টিফিন নিয়ে আসে। মা, বাবা, চার ভাইবোন নিয়ে ছয় জনের সংসার। বাবা, মুন্সী আঃ রশিদ, খুলনা সদর হাসপাতালের হেড ক্লার্ক। একজনের কামাইয়ে ছয় জনের তিন বেলা অন্নই জোটে না। টিফিন আনবে কী করে? নিজের পেটে হাত বুলায় কবির। লেগে আছে পিঠের সাথে। এমনই চুপসানো পেট, কংকালসার বুক, লাঠির মতো হাত পা নিয়ে কত মানুষকে শুয়ে বসে থাকতে দেখেছে ও রাস্তায়, ফুটপাতে। স্কুলে যাওয়া আসার পথে। দেখেছে ওদের জ্বলজ্বলে চোখ। সে চোখে কি ওরই মতো ক্ষুধার আগুন জ্বলে? ও বুঝতে পারে না।
শেষ পিরিয়ড সমাজ পাঠ। আজ পড়াচ্ছে ভূগোল। ভূগোলে ওর মাথা বরাবরই গোল। ক্ষুধা পেটে তা আরও তালগোল পাকিয়ে যায়। দেশগুলোর নাম এত বিদঘুটে কেন হয়? কোন দেশের রাজধানী কোথায়, তা জেনে আমার কী লাভ? ভাবে কবির। ক্ষুধা ভুলতে মাথা নিচু করে দু'পা নাচাতে শুরু করে। কে যেন ওর কান ধরে বেঞ্চ থেকে এক ফুট উঁচুতে উঠিয়ে ফেলে। তাকিয়ে দেখে ফেন্সি স্যার। নাম ফ্রান্সিস চৌধুরী। চক্রাবক্রা কাপড় পরে। হেলে দুলে হাঁটে। মেয়েলি কণ্ঠে কথা বলে। ছেলেমেয়েরা পিছনে তাকে তাই ফেন্সি বলে ডাকে। ফেন্সি বাবুও এক কাঠি বাড়া। সে কবিরকে সম্রাট হুমাউন বলে। ওর ভালো নাম মুন্সী হুমাউন কবির। সে কান ধরে কবিরের মাথাটা এদিক ওদিক করতে করতে বলে,
- তা, সম্রাট হুমাউন, কোন দেশ জয়ের খুশিতে পা নাচানো হচ্ছিল?
ক্লাসে হাসির রোল ওঠে। একে তো পেটে খিধা, তার উপর সারা ক্লাসের সামনে এমন অপমান! লজ্জায় ওর চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। মুখে কোনো কথা ফোটে না। স্যার কান ছেড়ে দিতেই ধপাস করে বেঞ্চিতে বসে পড়ে। ফেন্সি স্যার জানতে চান,
- পড়া করে এসেছেন জাঁহাপনা?
একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো মাথা নাড়ে কবির। স্যার জিজ্ঞেস করেন,
- তা, বলেন দেখি, সব চেয়ে ঠাণ্ডা মহাদেশের নাম কী?
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। এই একটা মহাদেশের নাম ও ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারে না। কি যেন টিকটিকির মতো নাম। অনেক চেষ্টার পর কোনো মতে বলতে পারে,
- ছার, এন্টিটিকা।
- বাহ, কেয়াবাত, মহান সম্রাট একটা মহাদেশের নাম তো বদলাতেই পারেন। বেঞ্চের উপর উঠে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
চিকন গলায় চিৎকার করে উঠেন ফ্রান্সিস চৌধুরী। ব্যাস, এইটুকুই বাকি ছিল, এবার ষোলো কলা পূর্ণ হল। বাকি ক্লাসটা দাঁড়িয়েই কাটাতে হবে। খুব রাগ হয় কবিরের। নাহয় একটু উচ্চারণ ভুলই করেছে। তাই বলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? তবে এক দিক দিয়ে ভালই হল। আজ আর পড়া ধরবে না। হাত উঁচু করে কান ধরে থাকতে থাকতে হাত ব্যথা করে ওর, শেষে নিজের কান ধরে নিজেই ঝুলে থাকে। সাথে ঝুলে থাকে বৈরি সময়।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুম চলে আসে কবিরের। ঘুম ঘুম চোখে সে দেখে, ফেন্সি স্যার সারা ক্লাসময় হেঁটে হেঁটে পড়াচ্ছেন। কী পড়াচ্ছেন, ঠিকমত কানে যায় না ওর। তবে হঠাৎ একটা নাম শুনে ঘুম ছুটে যায় কবিরের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফেন্সি স্যার বলছেন, " তোমরা শুনে খুশি হবে যে আজ বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সার্কিট হাউজ ময়দানে ভাষণ দেবেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির জাতির পিতা, এই প্রবাদ প্রতিম মানুষটিকে দেখতে চাইলে তোমরা বিকালে সার্কিট হাউজ মাঠে আসতে পারো"।
মূল লেখক - ডাঃ আফতাব হোসেন।
ঢং, ঢং, ঢং, ঢং।
কান খাড়া করে গোনে কবির। এক, দুই, তিন, চার। এখনও এক ঘণ্টা বাকি। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে কবিরের। সেই কোন সকালে দুটা শুকনা রুটি খেয়ে এসেছে। ঘণ্টা দুই আগেই তা হজম হয়ে গেছে। সেই থেকে পেটের অলিতে গলিতে ছুঁচোদের আনাগোনা, থেকে থেকে মিছিল, শ্লোগান। ভিক্টোরিয়া ইনফ্যান্ট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বছর দশেক বয়স। ছোটখাটো, শুকনা-পটকা শরীর। বয়সের তুলনায় বেশ ছোটোই দেখায়। তবু এত খিধা লাগে ক্যান? ওর মাথায় আসে না। যদিও অনেকে ছোট্ট প্লাস্টিকের বক্সে টিফিন নিয়ে আসে। মা, বাবা, চার ভাইবোন নিয়ে ছয় জনের সংসার। বাবা, মুন্সী আঃ রশিদ, খুলনা সদর হাসপাতালের হেড ক্লার্ক। একজনের কামাইয়ে ছয় জনের তিন বেলা অন্নই জোটে না। টিফিন আনবে কী করে? নিজের পেটে হাত বুলায় কবির। লেগে আছে পিঠের সাথে। এমনই চুপসানো পেট, কংকালসার বুক, লাঠির মতো হাত পা নিয়ে কত মানুষকে শুয়ে বসে থাকতে দেখেছে ও রাস্তায়, ফুটপাতে। স্কুলে যাওয়া আসার পথে। দেখেছে ওদের জ্বলজ্বলে চোখ। সে চোখে কি ওরই মতো ক্ষুধার আগুন জ্বলে? ও বুঝতে পারে না।
শেষ পিরিয়ড সমাজ পাঠ। আজ পড়াচ্ছে ভূগোল। ভূগোলে ওর মাথা বরাবরই গোল। ক্ষুধা পেটে তা আরও তালগোল পাকিয়ে যায়। দেশগুলোর নাম এত বিদঘুটে কেন হয়? কোন দেশের রাজধানী কোথায়, তা জেনে আমার কী লাভ? ভাবে কবির। ক্ষুধা ভুলতে মাথা নিচু করে দু'পা নাচাতে শুরু করে। কে যেন ওর কান ধরে বেঞ্চ থেকে এক ফুট উঁচুতে উঠিয়ে ফেলে। তাকিয়ে দেখে ফেন্সি স্যার। নাম ফ্রান্সিস চৌধুরী। চক্রাবক্রা কাপড় পরে। হেলে দুলে হাঁটে। মেয়েলি কণ্ঠে কথা বলে। ছেলেমেয়েরা পিছনে তাকে তাই ফেন্সি বলে ডাকে। ফেন্সি বাবুও এক কাঠি বাড়া। সে কবিরকে সম্রাট হুমাউন বলে। ওর ভালো নাম মুন্সী হুমাউন কবির। সে কান ধরে কবিরের মাথাটা এদিক ওদিক করতে করতে বলে,
- তা, সম্রাট হুমাউন, কোন দেশ জয়ের খুশিতে পা নাচানো হচ্ছিল?
ক্লাসে হাসির রোল ওঠে। একে তো পেটে খিধা, তার উপর সারা ক্লাসের সামনে এমন অপমান! লজ্জায় ওর চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। মুখে কোনো কথা ফোটে না। স্যার কান ছেড়ে দিতেই ধপাস করে বেঞ্চিতে বসে পড়ে। ফেন্সি স্যার জানতে চান,
- পড়া করে এসেছেন জাঁহাপনা?
একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো মাথা নাড়ে কবির। স্যার জিজ্ঞেস করেন,
- তা, বলেন দেখি, সব চেয়ে ঠাণ্ডা মহাদেশের নাম কী?
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। এই একটা মহাদেশের নাম ও ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারে না। কি যেন টিকটিকির মতো নাম। অনেক চেষ্টার পর কোনো মতে বলতে পারে,
- ছার, এন্টিটিকা।
- বাহ, কেয়াবাত, মহান সম্রাট একটা মহাদেশের নাম তো বদলাতেই পারেন। বেঞ্চের উপর উঠে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
চিকন গলায় চিৎকার করে উঠেন ফ্রান্সিস চৌধুরী। ব্যাস, এইটুকুই বাকি ছিল, এবার ষোলো কলা পূর্ণ হল। বাকি ক্লাসটা দাঁড়িয়েই কাটাতে হবে। খুব রাগ হয় কবিরের। নাহয় একটু উচ্চারণ ভুলই করেছে। তাই বলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? তবে এক দিক দিয়ে ভালই হল। আজ আর পড়া ধরবে না। হাত উঁচু করে কান ধরে থাকতে থাকতে হাত ব্যথা করে ওর, শেষে নিজের কান ধরে নিজেই ঝুলে থাকে। সাথে ঝুলে থাকে বৈরি সময়।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুম চলে আসে কবিরের। ঘুম ঘুম চোখে সে দেখে, ফেন্সি স্যার সারা ক্লাসময় হেঁটে হেঁটে পড়াচ্ছেন। কী পড়াচ্ছেন, ঠিকমত কানে যায় না ওর। তবে হঠাৎ একটা নাম শুনে ঘুম ছুটে যায় কবিরের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফেন্সি স্যার বলছেন, " তোমরা শুনে খুশি হবে যে আজ বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সার্কিট হাউজ ময়দানে ভাষণ দেবেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির জাতির পিতা, এই প্রবাদ প্রতিম মানুষটিকে দেখতে চাইলে তোমরা বিকালে সার্কিট হাউজ মাঠে আসতে পারো"।