"পাটের শাড়ি পিইন্ধা গো ঝিধন
বাবার ছানমন খাড়া গো ঝিধন, বাবার ছানমন খাড়া
হাইস্য মুখে দেও বিদায় বাবা
যাইতাম পরের ঘরে ও বাবা, যাইতাম পরের ঘরে
কারো লাগি পালছিলাম ঝি ধন
রাজার চারকি কইরা গো ঝি ধন, বাদশাহর চারকি কইরা
পরের পুতে লইয়া না যায়গা ঝি ধনরে বুকে ছেল দিয়া"
বাবার ছানমন খাড়া গো ঝিধন, বাবার ছানমন খাড়া
হাইস্য মুখে দেও বিদায় বাবা
যাইতাম পরের ঘরে ও বাবা, যাইতাম পরের ঘরে
কারো লাগি পালছিলাম ঝি ধন
রাজার চারকি কইরা গো ঝি ধন, বাদশাহর চারকি কইরা
পরের পুতে লইয়া না যায়গা ঝি ধনরে বুকে ছেল দিয়া"
নিজ আদরের কন্যাকে মা তুলে দিচ্ছেন অন্যের ঘরে বউ বানিয়ে। এমন বিষাদের দিনে হৃদয়স্পর্শী আবেদন তার ফুটে উঠেছে গান হয়ে। সে গানে নেই কোন শাস্ত্রীয় রাখঢাক, সাংগীতিক নন্দনকলার বালাই নেই, নেই পেশাদার গায়কী। বাংলার নিভৃত পল্লীর আনাচে কানাচে থাকা দুঃখিনী নারীরা নিজেদের অজান্তে গড়ে তুলেছেন পল্লীসাহিত্যের সমৃদ্ধ এক উপাদান, তাদের কন্ঠে বেড়ে উঠেছে চমকপ্রদ মেয়েলি গীত। যার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছেন গ্রামীণ নারীরা। তারাই রচয়িতা, তারাই সুরকার আবার তারাই এই সংগীতের শিল্পী।মেয়েলি গীত
মেয়েলি গীত এক ধরণের লোকগীতি। মেয়েলি গীতের প্রচলন ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তা ঠিক জানা না গেলেও আবহমানকাল ধরে গ্রামীণ নারীরা এই সংগীতকে লালন করে আসছেন। পারিবারিক এবং সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে কখনো একক এবং বহুলাংশে দলবঁধে নারীরা এই সংগীত পরিবেশন করতেন। নিতান্ত অশিক্ষিত এসব নারীদের হাতে সংগীতের এই ধারা লালিত পালিত হয়ে আসার কারণে গানগুলোর প্রকৃত রচয়িতা কে কিংবা কারা এই নিয়ে লোকগীতি গবেষকরা অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। অপেশাদার এসব নারীরা যেকোন অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে এসব গীত পরিবেশন করতেন। বেশিরভাগ সময়ই বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এসব গান রচিত হত বলে একে বিয়ের গীতও বলা হয়। তবে বিয়ের গীত ছাপিয়ে মেয়েলি গীত হয়ে উঠেছিল বাংলার নারীদের সুখদুঃখ, হতাশা, নৈরাশ্য, বিরাগ ইত্যাদি অনুভূতির মোক্ষম মাধ্যম। করুণ সুরে সমস্বরে নারীরা যখন সংগীত পরিবেশন করত তখন অকুস্থলে থাকা পুরুষরাও বেশ উপভোগ করত। মেয়েলি জীবনের সুখদুখ, হাসিঠাট্টা আর আদিম রসাত্মক অনুভূতিতে পুরুষ সমাজের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। তাই কখনো অন্তঃপুরে থেকে নারীরা নিজেদের মধ্যে মেয়েলি গীতের রস আস্বাদন করত। মেয়েলি গীতে কোন ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হত না। বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন পর্বে মেয়েলি গীত পরিবেশিত হত। কন্যার গায়ে হলুদ,মেহেদি তোলা, বর-কনে স্নান, কনে সাজানো, বর-বরণ, বিদায় ইত্যাদি পর্বে প্রাসঙ্গিক গীত পরিবেশন করে বিবাহ অনুষ্ঠানকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলত শিল্পীরা। সাংগীতিক মাধুর্যের অনুপস্থিতির সুযোগে এবং মুখ্যত অপেশাদারিত্বের কারণে দলের শিল্পীরা কোরাস থেকে দলছুট হয়ে গীতকে করে তুলত বেখাপ্পা যা মূলত দুই তিনজন পারদর্শী শিল্পীর গলায় চড়ে শুদ্ধ হত। বিয়ের উপলক্ষ ছাড়াও কখনো সন্তান জন্মক্ষণ, নাইওর আসা, মেয়েদের নিজস্ব ব্রত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও মেয়েলি গীত পরিবেশিত হত। সহজ সরল গীতিকা আর সুরের এসব গানে প্রকৃতপক্ষে মিশে থাকত গ্রামীণ নারীদের জীবনের আখ্যান। নিজেদের সরলতা দিয়ে উপমা তৈরি করে গীতিকার সুরকাররা কখনো নিজেদের স্বত্ব চাইতেন না, জাহিরও করতেন না। এক প্রকার নিরবেই এসব গান মুখে মুখে বদল হয়ে বিকৃত হয়ে কখনো হারিয়ে যেত। আবার কোন একজন গাতক নতুন করে সুর বসাতেন আবার সেই একই সহজ ভাষার গীতিকাব্যে, জমে উঠত গৃহস্থের উঠান, বাংলার নারীরা তখনো জানতেন না তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এ অঞ্চলের লোকসাহিত্যের মূল্যবান দলিল।
"রহিমনের আম্মা কান্দে পিছদরে বসিয়া
আমি অইনা রহিমনরে পালছি এত না আদর কইরা
এত না কষ্ট কইরা
আজ দেহি পরের গো পুতে লইয়া তারে যায়গা
বুকে শেল দিয়া
রহিমনের আব্বা কান্দে হুমুকদরে বইয়া
আমি অইনা রহিমনরে পালছি এতনা আদর কইরা"
গান গাইবার পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হয়না মেয়েলি গীতে। থাকত না কোন বাদ্যযন্ত্রের কারসাজি। অনাড়ম্বর উপস্থাপনার এসব গীতকে তাই এনে দিয়েছিল নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য। অঞ্চলভেদে গীতের লিরিকে তারতম্য পরিলক্ষিত হত। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের রীতিনীতি এবং কৃষ্টি কালচার প্রভাবক হিসেবে কাজ করত মেয়েলি গীতে। যেমন কিশোরগঞ্জ বা সুনামঞ্জের হাওর বেষ্টিত দুর্গম অঞ্চলে কন্যার বাবার বাড়ি আসা (নাইওর) কে কেন্দ্র করে যেমন মেয়েলি গীত রচিত হত অপরাপর অঞ্চলে তেমন বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আসর বসত এসব গীতের। বিশেষ উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে রচিত হওয়া এসব গীত নতুন গীত দ্বারা চাপা পড়ে যেত। যুগের চাহিদা এবং পরিবেশ পরিস্থিতির নতুনত্ব মেয়েলি গীতকে করে তুলত পূর্বের থেকে আরো অগ্রসরমান। বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যেত অনেক গান। ছিলনা কারো মাথাব্যথা। সরলতার মাধুর্যের সব উপকরণ দিয়েই নারীরা সাজিয়ে রাখত পল্লীসাহিত্যের এই উপাদানকে। উৎসব পার্বণ ছাড়াও মেয়েলি গীত হয়ে উঠেছিল নিঃসঙ্গ নারীদের সাথী। কষ্টের পীড়ন থেকে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে আসত করুণ গান। স্বামীর হাতে মার খেয়ে খেয়ে অতিষ্ঠ নারীদের কন্ঠে বেড়ে উঠত অভাগী সুর। চিরদুখিনীর সারল্য আর নিরুপায় নারীদের গীত তখন উপস্থাপন করত পুরুষশাসিত সমাজে নিজেদের দুর্দশার গল্প। আজকের দিনের অনেকেই বলবেন, পল্লীসাহিত্যের অন্যসব উপাদানের মত মেয়েলি গীতের আবেদন এবং শক্তিমত্তা ততোটা জোরালো নয় কিন্তু কালের বিচার এবং পিছিয়ে পড়া বদ্ধ নারীজীবনের ক্ষুদ্র কিছু সময় থেকে তারা যে এতোখানি ঋণের জালে আমাদের আটকে রেখে গেছেন তাই বা কম কি।
গ্রামীণ জীবনের সরলতার সাথে সংগ্রামী বধূদের একাত্মতার ফলাফলে কখনো উৎসবে পার্বণে নারী তার ভেতরকার দুঃখকষ্ট উগরে দিত, দু ফোটা চোখের জলের সাথে ফোকলা দাঁতের হাসি আর কন্ঠে বেসুরো ধ্বনি তাদেরকে মহানায়িকা করে না তুললেও ইতিহাস তাদের মুখের গানগুলোকে ধারণ করেছে। স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলা লোকগীতির সম্পদ হিসেবে। আজো বাংলাদেশের পল্লীগ্রামে বসে কোন নিঃসঙ্গ শেরপা আপন মনে হয়তো রোমন্থন করছে সেই স্মৃতিময় দিনগুলো, গুনগুনিয়ে গাইছে সেইসব গান, বাংলার নারীদের গান।