প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা প্রাচীন বাংলার এক জনপদের নাম পুণ্ড্র। এই জনপদেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী মহাস্থানগড়; যা কিনা বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক ও পর্যটকদের কাছে অতি আকর্ষনীয় একটি পুরাকীর্তি।
প্রাচীনকালে এই এলাকাটি পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামেই পরিচিত ছিল। তবে কালের আবর্তে এটি মহাস্থানগড় নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মহাস্থানগড় শব্দের মহা মানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, আর গড় অর্থ উচ্চ স্থান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও প্রত্নতাত্ত্বিক কারণে এই স্থানের গুরুত্ব অনেক উঁচুতে, এছাড়াও এই স্থানটির ভূমি বেশ উঁচু; ফলে এটি মানুষের কাছে মহাস্থানগড় নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় বগুড়া শহর থেকে উত্তর দিকে ১৩ কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীর তীরে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গোড়াপত্তন হয়েছিল আজকের এই মহাস্থানগড়ের। পুণ্ড্রনগর মৌর্য ও গুপ্ত রাজবংশের রাজাদের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল। তারপর মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন বংশের রাজারা ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলটিকে তাদের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে শাসন করে আসছিল। কিন্তু সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন, তখন এই স্থানে শাসন ক্ষমতা চলে যায় নল নামের এক রাজার হাতে; যিনি সেন বংশের ছিলেন না । তবে এই রাজার সঙ্গে তার ভাই নীলের দ্বন্দ্ব ছিল চরম মাত্রায়।
এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিতে ভারতের দক্ষিণ থেকে "ব্রাহ্মণ" নামক এক ব্যক্তি এখানে আসেন; যিনি কি-না মাতৃ হত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। তিনি এই দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করার নামে কৌশলে নিজেই রাজা হন। আমরা ইতিহাসে পরশুরাম নামক যে অত্যাচারী শাসকের নাম শুনতে পাই সেই ছিল এই ব্রাহ্মণ; যার অন্য নাম ছিল রাম। তিনি এই রাম নাম থেকেই ইতিহাসে পরশুরাম নামে পরিচয় লাভ করেন।
এই রামের অত্যাচারে এই অঞ্চলের মানুষ যখন অতিষ্ঠ, তখনই শাহ সুলতান বলখী (রহ.) ইসলাম প্রচারের জন্য বলখী নগর থেকে এই অঞ্চলে আসেন। ধারণা করা হয়, তিনি মাছের পিঠে করে এই বরেন্দ্র অঞ্চলে এসেছিলেন। এই জন্য তিনি মাহিসাওয়ার নামেও সুপরিচিত। তার সঙ্গে পরশুরামের যুদ্ধ হয়; যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হয়। ফলে শাহ সুলতান(রহ.) এখানে বাধাহীনভাবে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পেয়ে যান। তার মাজার শরীফও এখনো মহাস্থানগড়ে রয়েছে।
তখনকার সময়ে পুণ্ড্রনগরে চীন, তিব্বতসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ লেখাপড়াসহ বিভিন্ন কাজে এখানে আসতো, কারণ তখন এটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি নগরী। মহাস্থানগড়ের উত্থান কাল থেকেই এটি তীর্থস্থান হিসেবেও খ্যাত হতে থাকে; ফলে এখানে সময়ভেদে হিন্দু, ব্রাহ্মণ ও মুসলমানদের প্রচুর আনাগোনা ছিল।
কিন্তু ১৫ শতাব্দীর পর থেকে মহাস্থানগড়ে মানুষের আনাগোনা কমতে থাকে এবং এর অস্তিত্বও বিলীন হতে থাকে। কারণ চৌদ্দশ শতকে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গৌড়, বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, হরিকেল, সমতট ইত্যাদি নিয়ে "বাঙ্গালা" নামে অখণ্ড এক রাজ্য গড়ে তোলেন, ফলে আলাদাভাবে মহাস্থানগড়ের গুরুত্ব ও সুপরিচিতি কমে যায়। একটি সময় এসে মহাস্থানগড় তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে এবং ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়।
বহুকাল বাংলার এই প্রাচীন নগরী ধ্বংসাবশেষ হিসেবে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও ১৮০৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন সর্বপ্রথম মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেন। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার কানিংহাম ধারণা প্রকাশ করেন এটিই ছিল পুন্ড্রবর্ধন।
১৯২৮-২৯ সালে এখানে প্রথম খননকার্য শুরু করা হয়। তাতে মহাস্থানগড় আবার জনসম্মুখে চলে আসে। মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষের আয়তন প্রায় ৭৮ বর্গ কিলোমিটার। এতে রয়েছে প্রাচীনকালের তৈরি একটি ভাঙ্গা দুর্গ, খোদার পাথর ভিটা, বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, লক্ষিন্দরের বাসর ঘর হিসেবে পরিচিত গোকুল মেধ, মঙ্গলকোট, তোতারাম পন্ডিতের ধাপ, মানকালির ঢিবি, ভাসু বিহার, ভিমের জঙ্গল, শীলাদেবীর ঘাট, কালিদহ সাগর, পরশুরামের প্রাসাদ ইত্যাদি সব পুরাকীর্তি।
মহাস্থানগড়ের এমন ইতিহাস-ঐতিহ্য ও গুরুত্ব বিবেচনা করে করোতোয়া নদীর তীর ঘেষে মহাস্থানগড়ের টিলা সংলগ্ন এলাকায় ১৯৬৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে থেকে উদ্ধারকৃত প্রাচীন সব জিনিসপত্র।