প্যারালেল ইউনিভার্স এন্ড দ্যা অবজার্ভার
(একটি বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী)
মূল লেখকঃ জনাব আসিফ রহমান জয়
পর্ব-১
দেখতে দেখতে বাইকের স্পিডোমিটারের কাঁটা সত্তর ছাড়িয়ে গেলো। কাকরাইলের সামনের পাকা রাস্তা পেরিয়ে বাইক তখন মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে। ছুটির দিন, ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা পেরিয়ে গেছে, কিছুক্ষণ আগে একপশলা কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তায় গাড়ির ভীড় তেমন একটা নেই বললেই চলে। ঝড়ের বেগে বাইক চলছে।
পিছনের সিট থেকে বন্ধু মুহিত বললো-
-'কি মনু, এতো স্পিড কেন? মনের মধ্যে অনেক ফুর্তি মনে হয়!'
-'ফুর্তি তো হবেই!', রায়হান পিছন দিকে মাথা হেলিয়ে উত্তর দেয়। বাতাসের বেগে ঠিকমতো কথা শোনা যায় না। 'আর মাত্র দশ কপি বই আছে। সেকেন্ড এডিশন সামনের সপ্তাহেই আসছে। বইমেলার আরো দশ দিন বাকী আছে। প্রকাশক খুশী, আমিও খুশী... আবার জিগায়!'
-'ফুর্তি কি শুধু এই জন্য নাকি...ওইযে সুন্দরী মেয়েটা, শাড়ি পড়ে আসছিলো, অটোগ্রাফ দেয়ার সময় যে খুব হেসে হেসে সেলফি তুললো, সেই জন্য?'
রায়হান হেসে উঠলো-
-'আরে নাহ, তুই নিজেও তো সাথেই ছিলি। এরকম প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে। সেরকম কিছু না।'
-'যাই বলিস, মেয়েটা যেমন সুন্দর ওর হাসিটাও কিন্তু দারুণ মিষ্টি...'
মুহিত আবেগে পিছন থেকে রায়হানকে জড়িয়ে ধরে। মুহিতের মোটা-সোটা শরীরের নড়াচড়ায় রায়হানেরর বাইকও নড়ে-চড়ে ওঠে।
-'ছাড়... হারামজাদা।' রায়হান কপট ধমকে ওঠে, 'বাইকের পিছনে চুপ করে বসে থাক। নড়া-চড়া কম কর, নাহলে এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে। রাস্তা এমনিতেই পিচ্ছিল আর বাসায় ফিরতেও দেরী হয়ে গেছে।'
রায়হান বাইকের স্পীড আরও একটু বাড়িয়ে দিলো। ঘড়িতে তখন দশটা বেজে পনেরো। সামনেই ডিভাইডার। একটা রাস্তা চলে গেছে সোনারগাঁ হোটেলের দিকে, আরেকটা সোজা তেজগাঁর দিকে। রায়হান তেজগাঁর রাস্তাটা ধরলো।
ঠিক সেই সময় চারদিকে আলোর ঝলকানি দিয়ে বজ্রপাতের মতো তীব্র আওয়াজ হলো! কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বাইক স্কিড করে ডিভাইডারের এক পাশে ছেঁচড়ে পড়লো। রায়হান আর মুহিত ও বাইক থেকে ছিটকে পড়ে গেলো। রায়হানের মনে হলো, ভারী কোন কিছু যেন তার মাথায় আঘাত করেছে, তার মাথার ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। সে যেন অনন্তকাল ধরে কোন গর্তে পড়েই যাচ্ছে...পড়েই যাচ্ছে, চারদিকে ভীষণ অন্ধকার, নিকষ কালো অন্ধকার। শরীর জুড়ে প্রচন্ড ব্যথা, রায়হান সেই তীব্র ব্যথা নিয়ে জ্ঞান হারালো।
(দুই)
কিছুক্ষণ পর।
রায়হান ধীরে ধীরে চোখ মেললো। চোখের সামনে রাতের পরিস্কার আকাশ, আকাশ ভর্তি তারার মেলা। রায়হান অবাক হয়ে তারা দেখতে লাগলো, তারাগুলো যেন অল্প অল্প করে নীচে নেমে আসছে... অনেকখানি নীচে... আরো নীচে...আরো ... আরো নীচে... রায়হান ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আবারো ভয়ে ভয়ে চোখ মেললো। নাহ, এখন মনে হচ্ছে তারাগুলো জায়গা মতোই আছে! ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে ধ্রুব তারা, তার আরেকটু নীচে সপ্তর্ষীমন্ডল! মাথার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, আবার মনে হচ্ছে কারা যেন মাথার ভেতর ফিস ফিস করে কথা বলছে-
-'উঠেন তো ভাই... উঠে পড়েন। আপনার কিছু হয়নি... উঠে একটু গা ঝাড়া দেন দেখি...'
রায়হান মাথা ঝাঁকি দিলো। এদিক-ওদিকে তাকালো। কোথায়? আশে-পাশে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কারা কথা বলছে? রায়হান চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো। শরীরে ব্যথা আছে ঠিকই তবে এখন অনেক কম মনে হচ্ছে। কি হয়েছে ভাবতেই, মূহুর্তের মধ্যে সব মনে পড়ে গেলো! চমকে উঠে পাশে তাকালো, বাইকটা একটু দূরে ডিভাইডারের গা ঘেষে কাত হয়ে আছে আর বাইকের কিছুটা দূরে মুহিত উপুর হয়ে পড়ে আছে। রায়হান টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। মুহিতের কাছে যেতে হবে, ওর অবস্থা কি হয়েছে কে জানে?
-'মুহিত... মুহিত... শুনতে পাচ্ছিস? দোস্ত... '
কোনো সাড়াশব্দ নেই! হায় হায়! মুহিতের শরীর কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। শ্বাস পড়ছে কিনা, তাও বোঝা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় কি যেন করতে হয়! রায়হানের মাথা কাজ করছে না। আবছা ভাবে মনে পড়লো, এই অবস্থায় CPR দিতে হবে। রায়হান মুহিতকে দ্রুত চিত করলো, মুহিতের বুকে দুই হাত দিয়ে চাপ দিতে লাগলো। এক...দুই...তিন...চার...পাঁচ... নাহ... কোন রেসপন্স নেই! আবার বুকে চাপ দিতে লাগলো... এক...দুই...তিন...চার... পাঁচ... রায়হান ফুঁপিয়ে উঠলো। নো রেসপন্স! রায়হান হাল ছাড়লো না। হঠাৎ'ই মুহিত গুংগিয়ে উঠলো! রায়হান হাঁফ ছেড়ে ডিভাইডারের গায়ে হেলান দিলো, ওর হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। যাক, বেঁচে আছে তাহলে! খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। মুহিত খক খক করে কাশছে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, যদিও এখনো চোখ খোলেনি। রায়হান মুহিতের হাত পা নেড়ে দেখতে লাগলো, সব তো মনে হয় ঠিক আছে।
-মুহিত...মুহিত... শুনতে পাচ্ছিস... চোখ খোল...
মুহিত চোখ মেললো।
এক্সিডেন্টে ওদের কারো তেমন কিছু হয়নি। রায়হানের কপালের ডান পাশটা ঘষা লেগে ছিলে গেছে, ওখানে রক্ত জমে শুকিয়ে গেছে। আর মুহিত কনুই আর হাটুতে ব্যথা পেয়েছে, ওখানে চামড়াও উঠে গেছে, জ্বলছে কিন্তু হাড়-হাড্ডি কোন কিছু ভাঙ্গেনি। ওরা ধরাধরি করে বাইকটাকে সোজা করে তুললো। বাইকের হ্যান্ডেল বেকে গেছে, মোবিল বের হয়ে রাস্তা ভিজে আছে। দুজনে মিলে হ্যান্ডেল সোজা করে পাচ-ছয়বার কিক দিতে বাইকটা স্টার্ট নিলো। রায়হান বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। মুহিত বললো-
-'বাইক চালাতে পারবি?'
রায়হান ইতস্ততঃ করে বললো-
-'তা হয়তো পারবো কিন্তু তুই কি পিছনে বসতে পারবি? নাকি তোকে সিএনজি বা উবারে উঠিয়ে দিবো?'
মাথার ভিতর আবার কে যেন ফিসফিস করে উঠলো-
-'না, আলাদা হয়ো না। একসাথে থাকো। আমরা আসছি।'
মুহিত গা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো-
-'আমি পারবো। আমি ঠিক আছি, আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলেই হবে।'
-'ডাক্তারের কাছে একটু যাবি?'
-'না না... ঠিকই তো আছি। শুধু শরীরটা ব্যথা। বাসায় মলম আছে, প্যারাসিটামল আছে। কনুই আর হাটুতে মলম দিলেই হবে। কালকেও যদি ব্যথা থাকে তাহলে পরে যাবো।
রায়হান আর সিপিআর দেয়ার কথাটা বললো না, পরে একসময় বললেই হবে। ও বাইকে স্টার্ট দিলো।
বিজয় স্মরনীর মোড়ে সিগনালে বাইক দাঁড়িয়ে আছে। রায়হানের বেশ ক্লান্ত লাগছে। মাথার ভিতরের ফিসফিসানিটা মাঝে মাঝে বেড়ে যাচ্ছে, আবার কমেও যাচ্ছে। ডাক্তারকে একটু দেখিয়ে গেলে ভালো হতো। কিন্তু খুব ঘুমও পাচ্ছে। বাসায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। মুহিত বেশ অবাক হয়ে বললো-
-'আরেহ... তাজ্জব তো! আমাদের পুলিশ ফোর্সের ড্রেসের রঙ খয়েরী হলো কবে থেকে?'
সিগনালের মোড়ে তিনজন পুলিশ অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ড্রেসের রঙ তো নীল হবার কথা কিন্তু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, ওদের ড্রেসের রঙ খয়েরী।
-'কি জানি... সোডিয়ামের আলোতে হয়তো মনে হচ্ছে...'
রায়হান দুই হাত দিয়ে চোখ ডললো। তারপর ভাবলো, চোখ ডলাডলির কি আছে! সে তো আর একা খয়েরী রঙ দেখছে না। মুহিতই তো আগে দেখেছে। ইনডিউসড হেলুসিনেশন না তো! এক্সিডেন্ট হয়েছে, মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, এমন অবস্থায় মুহিত যে রঙটা দেখছে, সেও ওইটাই দেখছে। মাথার ভেতরের ফিসফিসানির ব্যাপারটা তো উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। রায়হানের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। সামথিং ইজ রঙ...
সিগনাল ছেড়ে দিলো। রায়হান খুব সাবধানে বাইক চালাতে লাগলো। বাইকের হ্যান্ডেলটা কেমন যেন একপাশে শক্ত হয়ে রয়েছে। চীন মৈত্রীর পার হয়েই আগারগাঁ আইডিবি ভবন। মুহিত বললো-
-'আমাকে এখানে নামিয়ে দে। আমি একটু রিক্সায় হাওয়া খেতে খেতে যাই।'
রায়হান রাস্তার এক পাশে বাইক থামালো।
-'তোর কাছে সিগারেট আছে?'
রায়হান পকেট থেকে সিগারেট বের করে দিলো। মুহিত সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হাত নেড়ে বললো-
-'খুব বড় একটা ফাঁড়া গেলো, তাই না?'
রায়হান হেলমেট খুলে ঘাম মুছলো-'তা ঠিক... অনেক বড় একটা বিপদ গেলো। মসজিদে কিছু টাকা দিয়ে দিতে হবে।'
-'একটা কথা বলবো?'
-'বল...'
-'দোস্ত, আমার এখনো কেমন যেন একটু ঘোর ঘোর লাগছে। তুই তো জানিস, এই জায়গায় আমি প্রতিদিন অফিসের গাড়ি থেকে নামি। বাকী রাস্তাটা রিক্সায় যাই। কেমন যেন মনে হচ্ছে, এই জায়গাটা আমার অচেনা। লাক্সের এই সাইনবোর্ডটা আমি প্রতিদিন দেখি, মেহজাবিনের বিজ্ঞাপন, আজকে সকালেও দেখেছি। কিন্তু এখন দেখছি এখানে অন্য সাইনবোর্ড! রাস্তার ওইপারে ফেয়ার এন্ড লাভলির একটা সাইনবোর্ড ছিলো, এখন দেখছি ফাঁকা হোর্ডিং। ঘটনা কি? আমি যা দেখছি, তুইও কি তাই দেখতেছিস?'
-'নয় এর ঘরের নামতা পড় তো?'
-'কেন?'
-'পড় না... দেখি মাথা ঠিক মতো কাজ করে কিনা।'
-'নয় একে নয়, নয় দুগুনে আঠারো, তিন নয়ে সাতাশ...'
-'সাত বারো কতো?'
-'চুরাশি'।
রায়হান হেসে ফেললো।
-'হুম মাথা তো মনে হয় ঠিক মতোই কাজ করছে। আর আমিও তো একই সাইনবোর্ড দেখতেছি। বড় একটা এক্সিডেন্ট গেছে তো, এইজন্যই হয়তো ঘোর ঘোর লাগছে। আমারও খুব টায়ার্ড লাগছে। তুই বাসায় যা। রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শোন, বাসায় পৌছে আমাকে একটা ফোন দিস।'
রায়হানের মাথার ভেতর কে যেন ফিস ফিস করে বললো-
-'ওকে ছেড়ো না। দু'জন একসাথে থাকো। ঝামেলা হয়ে যাবে... একসাথে থাকো...'
রায়হান এদিক-ওদিক মাথা ঝাঁকিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন হচ্ছে। বাসায় পৌছে ঘুমের ওষুধ খেয়ে কড়া একটা ঘুম দিতে হবে।
(তিন)
গ্যারেজের মেকানিক হালিম এক্সিডেন্টের কথা শুনে আর বাইকের অবস্থা দেখে আকাশ থেকে পড়লো-
-'আহারে স্যার, কন কি...এক্সিডেন হইছে কুনহানে? ব্যথা পাইছেন নি? নাহ... গাড়িটা ভালোই ক্ষতি হইছে... একপাশের রঙ পুরাই চইটা গেছে, হ্যান্ডেল ট্যাপ খাইছে, আর পিছনের লাইটটা পুরাই চেঞ্জ করতে হবে।
এই বলে কিছুটা থমকে গেলো। রায়হান বললো-
-'কি হইছে?'
-'স্যারে কি এর মইদ্দে লাইটসেট অন্য কুনুহান থাইক্কা লাগাইছিলেন? আপনের তো হিরো হাঙ্ক এর অরিজিনাল লাইট আছিলো, অহন তো দেহি, সুযুকির লাইটসেট লাগাইন্না...'
রায়হান বিরক্ত গলায় ধমকে উঠলো-
-'ওই মিয়া, তুমিই তো গত মাসে লাগায় দিছো। হাঙ্ক পাইলা না, তারপর সুযুকি লাগায় দিলা...'
মেকানিক হালিম বিড়বিড় করতে থাকলো-'কন কি বস? আমি কহন লাইটসেট চেঞ্জ করলাম?'
রায়হান রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে এলো। সুন্দর বাতাস হচ্ছে। মেঘ ডেকে উঠলো, সারারাত হয়তো বৃষ্টি হবে।
রায়হান ওর এপার্টমেন্টের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লিফট নামছে...লিফটের ডিসপ্লেতে উঠছে – ৮...৭...৬...৫...৪... রায়হানের খুব ঘুম পাচ্ছে। মাথার মধ্যে ফিসফিসানি এখন বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে কিন্তু কে কি বলছে স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
"টিং" করে মিষ্টি একটা আওয়াজ করে লিফট খুলে গেলো। রায়হান লিফটে ঢুকে পড়তেই মাথার ফিসফিসানি আরো জোরে-সোরে শোনা যেতে লাগলো। রায়হান দ্রুত ৬ নাম্বার বাটন টিপে দিলো। বাসায় যেয়েই ফ্যামিলি ডাক্তারকে ফোন করতে হবে। লিফটের দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগের মূহুর্তে দু'জন মাঝবয়সী লোককে প্রায় দৌড়ে লিফটের দিকে আসতে দেখা গেলো। ওদের মধ্যে একজন হাত তুলে লিফটের দরজা খোলা রাখতে ইশারাও করলো। রায়হান লিফট খোলা থাকার বাটন টেপার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে লিফট ওপরে উঠতে শুরু করলো। লিফটের বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে রায়হান গলার আওয়াজ শুনতে পেলো-
-'ধ্যাত... এখন আবার সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় উঠতে হবে।'
-'সব দোষ তোমার! এতো কাছ থেকে তোমার ডিভাইস কাজ করে না। ডিজগাস্টিং!'
-'চুপ থাকো!'
গলার শব্দ হারিয়ে গেলো। লিফট সাততলায় পৌছে গেছে।
রায়হান কলিং বেলে টিপে দেয়ালে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে। ভেতর থেকে ওর বড় মেয়ে চৈতি জিজ্ঞেস করলো-
-'কে?'
রায়হান ক্লান্ত গলায় বললো-'মামনি আমি, দরজা খোলো।'
চৈতি দরজা খুলে ওকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলো! রায়হান বুঝলো, ওর কপালের ছিলে যাওয়া দাগটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে, তাই অবাক হয়েছে। রায়হান হাত তুলে কিছুটা আশ্বস্ত করার ভংগিতে বললো-
-'চিন্তা করো না মামনি... ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে! আমি ঠিক আছি, শুধু কপালে একটু কেটে গেছে...'
চৈতির অবাক ভাব কিছুতেই কাটছেই না! সে যেন ভুত দেখেছে! রায়হান দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিতেই ও একটু পিছিয়ে গেলো। বাসার ভেতরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জোর গলায় ডাকলো-
-'মা, বাবা ... জলদি আসো...'
-'আরেহ... মাকে ডাকাডাকি করার দরকার নেই। কিছু হয়নি আমার... ছোট্ট এক্সিডেন্ট...কপালটা শুধু...'
বাসার ভেতরের করিডোর থেকে পুরুষালি ভরাট গলা ভেসে এলো-
-'চৈতি মামনি, কি হয়েছে? কে এসেছে?'
রায়হান চমকে উঠলো! করিডোরের ভেতরের দিকে তাকাতেই ওর মাথাটা আবারো বন করে ঘুরে উঠলো। চৈতি ভয় পেয়ে আরো এক ধাপ পিছিয়ে গেলো। করিডোরের মানুষটাও ভীষণ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হবারই কথা! মানুষটা আর একটু এগিয়ে রায়হানের সামনে এসে দাড়ালো।
রায়হানের গাঁ কেমন যেন গুলিয়ে উঠলো। কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে, অনেকটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন লাগে!
রায়হানের সামনে ঠিক যেন আরেকজন রায়হান দাঁড়িয়ে আছে!
এমন সময়। খোলা দরজা দিয়ে সেই লোক দু'জন হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
-'ধ্যাত, ঝামেলা হয়ে গেলো তো, ঠেকানো গেলো না। দু'জনের দেখা হয়েই গেলো। সব তোমার ডিভাইসের দোষ!!'
রায়হানের মাথার ভেতরটা আবারো ভীষণভাবে ঘুরে উঠলো! রায়হান দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারালো।
(একটি বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী)
মূল লেখকঃ জনাব আসিফ রহমান জয়
পর্ব-১
দেখতে দেখতে বাইকের স্পিডোমিটারের কাঁটা সত্তর ছাড়িয়ে গেলো। কাকরাইলের সামনের পাকা রাস্তা পেরিয়ে বাইক তখন মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে। ছুটির দিন, ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা পেরিয়ে গেছে, কিছুক্ষণ আগে একপশলা কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তায় গাড়ির ভীড় তেমন একটা নেই বললেই চলে। ঝড়ের বেগে বাইক চলছে।
পিছনের সিট থেকে বন্ধু মুহিত বললো-
-'কি মনু, এতো স্পিড কেন? মনের মধ্যে অনেক ফুর্তি মনে হয়!'
-'ফুর্তি তো হবেই!', রায়হান পিছন দিকে মাথা হেলিয়ে উত্তর দেয়। বাতাসের বেগে ঠিকমতো কথা শোনা যায় না। 'আর মাত্র দশ কপি বই আছে। সেকেন্ড এডিশন সামনের সপ্তাহেই আসছে। বইমেলার আরো দশ দিন বাকী আছে। প্রকাশক খুশী, আমিও খুশী... আবার জিগায়!'
-'ফুর্তি কি শুধু এই জন্য নাকি...ওইযে সুন্দরী মেয়েটা, শাড়ি পড়ে আসছিলো, অটোগ্রাফ দেয়ার সময় যে খুব হেসে হেসে সেলফি তুললো, সেই জন্য?'
রায়হান হেসে উঠলো-
-'আরে নাহ, তুই নিজেও তো সাথেই ছিলি। এরকম প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে। সেরকম কিছু না।'
-'যাই বলিস, মেয়েটা যেমন সুন্দর ওর হাসিটাও কিন্তু দারুণ মিষ্টি...'
মুহিত আবেগে পিছন থেকে রায়হানকে জড়িয়ে ধরে। মুহিতের মোটা-সোটা শরীরের নড়াচড়ায় রায়হানেরর বাইকও নড়ে-চড়ে ওঠে।
-'ছাড়... হারামজাদা।' রায়হান কপট ধমকে ওঠে, 'বাইকের পিছনে চুপ করে বসে থাক। নড়া-চড়া কম কর, নাহলে এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে। রাস্তা এমনিতেই পিচ্ছিল আর বাসায় ফিরতেও দেরী হয়ে গেছে।'
রায়হান বাইকের স্পীড আরও একটু বাড়িয়ে দিলো। ঘড়িতে তখন দশটা বেজে পনেরো। সামনেই ডিভাইডার। একটা রাস্তা চলে গেছে সোনারগাঁ হোটেলের দিকে, আরেকটা সোজা তেজগাঁর দিকে। রায়হান তেজগাঁর রাস্তাটা ধরলো।
ঠিক সেই সময় চারদিকে আলোর ঝলকানি দিয়ে বজ্রপাতের মতো তীব্র আওয়াজ হলো! কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বাইক স্কিড করে ডিভাইডারের এক পাশে ছেঁচড়ে পড়লো। রায়হান আর মুহিত ও বাইক থেকে ছিটকে পড়ে গেলো। রায়হানের মনে হলো, ভারী কোন কিছু যেন তার মাথায় আঘাত করেছে, তার মাথার ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। সে যেন অনন্তকাল ধরে কোন গর্তে পড়েই যাচ্ছে...পড়েই যাচ্ছে, চারদিকে ভীষণ অন্ধকার, নিকষ কালো অন্ধকার। শরীর জুড়ে প্রচন্ড ব্যথা, রায়হান সেই তীব্র ব্যথা নিয়ে জ্ঞান হারালো।
(দুই)
কিছুক্ষণ পর।
রায়হান ধীরে ধীরে চোখ মেললো। চোখের সামনে রাতের পরিস্কার আকাশ, আকাশ ভর্তি তারার মেলা। রায়হান অবাক হয়ে তারা দেখতে লাগলো, তারাগুলো যেন অল্প অল্প করে নীচে নেমে আসছে... অনেকখানি নীচে... আরো নীচে...আরো ... আরো নীচে... রায়হান ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আবারো ভয়ে ভয়ে চোখ মেললো। নাহ, এখন মনে হচ্ছে তারাগুলো জায়গা মতোই আছে! ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে ধ্রুব তারা, তার আরেকটু নীচে সপ্তর্ষীমন্ডল! মাথার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, আবার মনে হচ্ছে কারা যেন মাথার ভেতর ফিস ফিস করে কথা বলছে-
-'উঠেন তো ভাই... উঠে পড়েন। আপনার কিছু হয়নি... উঠে একটু গা ঝাড়া দেন দেখি...'
রায়হান মাথা ঝাঁকি দিলো। এদিক-ওদিকে তাকালো। কোথায়? আশে-পাশে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কারা কথা বলছে? রায়হান চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো। শরীরে ব্যথা আছে ঠিকই তবে এখন অনেক কম মনে হচ্ছে। কি হয়েছে ভাবতেই, মূহুর্তের মধ্যে সব মনে পড়ে গেলো! চমকে উঠে পাশে তাকালো, বাইকটা একটু দূরে ডিভাইডারের গা ঘেষে কাত হয়ে আছে আর বাইকের কিছুটা দূরে মুহিত উপুর হয়ে পড়ে আছে। রায়হান টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। মুহিতের কাছে যেতে হবে, ওর অবস্থা কি হয়েছে কে জানে?
-'মুহিত... মুহিত... শুনতে পাচ্ছিস? দোস্ত... '
কোনো সাড়াশব্দ নেই! হায় হায়! মুহিতের শরীর কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। শ্বাস পড়ছে কিনা, তাও বোঝা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় কি যেন করতে হয়! রায়হানের মাথা কাজ করছে না। আবছা ভাবে মনে পড়লো, এই অবস্থায় CPR দিতে হবে। রায়হান মুহিতকে দ্রুত চিত করলো, মুহিতের বুকে দুই হাত দিয়ে চাপ দিতে লাগলো। এক...দুই...তিন...চার...পাঁচ... নাহ... কোন রেসপন্স নেই! আবার বুকে চাপ দিতে লাগলো... এক...দুই...তিন...চার... পাঁচ... রায়হান ফুঁপিয়ে উঠলো। নো রেসপন্স! রায়হান হাল ছাড়লো না। হঠাৎ'ই মুহিত গুংগিয়ে উঠলো! রায়হান হাঁফ ছেড়ে ডিভাইডারের গায়ে হেলান দিলো, ওর হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। যাক, বেঁচে আছে তাহলে! খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। মুহিত খক খক করে কাশছে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, যদিও এখনো চোখ খোলেনি। রায়হান মুহিতের হাত পা নেড়ে দেখতে লাগলো, সব তো মনে হয় ঠিক আছে।
-মুহিত...মুহিত... শুনতে পাচ্ছিস... চোখ খোল...
মুহিত চোখ মেললো।
এক্সিডেন্টে ওদের কারো তেমন কিছু হয়নি। রায়হানের কপালের ডান পাশটা ঘষা লেগে ছিলে গেছে, ওখানে রক্ত জমে শুকিয়ে গেছে। আর মুহিত কনুই আর হাটুতে ব্যথা পেয়েছে, ওখানে চামড়াও উঠে গেছে, জ্বলছে কিন্তু হাড়-হাড্ডি কোন কিছু ভাঙ্গেনি। ওরা ধরাধরি করে বাইকটাকে সোজা করে তুললো। বাইকের হ্যান্ডেল বেকে গেছে, মোবিল বের হয়ে রাস্তা ভিজে আছে। দুজনে মিলে হ্যান্ডেল সোজা করে পাচ-ছয়বার কিক দিতে বাইকটা স্টার্ট নিলো। রায়হান বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। মুহিত বললো-
-'বাইক চালাতে পারবি?'
রায়হান ইতস্ততঃ করে বললো-
-'তা হয়তো পারবো কিন্তু তুই কি পিছনে বসতে পারবি? নাকি তোকে সিএনজি বা উবারে উঠিয়ে দিবো?'
মাথার ভিতর আবার কে যেন ফিসফিস করে উঠলো-
-'না, আলাদা হয়ো না। একসাথে থাকো। আমরা আসছি।'
মুহিত গা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো-
-'আমি পারবো। আমি ঠিক আছি, আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলেই হবে।'
-'ডাক্তারের কাছে একটু যাবি?'
-'না না... ঠিকই তো আছি। শুধু শরীরটা ব্যথা। বাসায় মলম আছে, প্যারাসিটামল আছে। কনুই আর হাটুতে মলম দিলেই হবে। কালকেও যদি ব্যথা থাকে তাহলে পরে যাবো।
রায়হান আর সিপিআর দেয়ার কথাটা বললো না, পরে একসময় বললেই হবে। ও বাইকে স্টার্ট দিলো।
বিজয় স্মরনীর মোড়ে সিগনালে বাইক দাঁড়িয়ে আছে। রায়হানের বেশ ক্লান্ত লাগছে। মাথার ভিতরের ফিসফিসানিটা মাঝে মাঝে বেড়ে যাচ্ছে, আবার কমেও যাচ্ছে। ডাক্তারকে একটু দেখিয়ে গেলে ভালো হতো। কিন্তু খুব ঘুমও পাচ্ছে। বাসায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। মুহিত বেশ অবাক হয়ে বললো-
-'আরেহ... তাজ্জব তো! আমাদের পুলিশ ফোর্সের ড্রেসের রঙ খয়েরী হলো কবে থেকে?'
সিগনালের মোড়ে তিনজন পুলিশ অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ড্রেসের রঙ তো নীল হবার কথা কিন্তু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, ওদের ড্রেসের রঙ খয়েরী।
-'কি জানি... সোডিয়ামের আলোতে হয়তো মনে হচ্ছে...'
রায়হান দুই হাত দিয়ে চোখ ডললো। তারপর ভাবলো, চোখ ডলাডলির কি আছে! সে তো আর একা খয়েরী রঙ দেখছে না। মুহিতই তো আগে দেখেছে। ইনডিউসড হেলুসিনেশন না তো! এক্সিডেন্ট হয়েছে, মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, এমন অবস্থায় মুহিত যে রঙটা দেখছে, সেও ওইটাই দেখছে। মাথার ভেতরের ফিসফিসানির ব্যাপারটা তো উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। রায়হানের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। সামথিং ইজ রঙ...
সিগনাল ছেড়ে দিলো। রায়হান খুব সাবধানে বাইক চালাতে লাগলো। বাইকের হ্যান্ডেলটা কেমন যেন একপাশে শক্ত হয়ে রয়েছে। চীন মৈত্রীর পার হয়েই আগারগাঁ আইডিবি ভবন। মুহিত বললো-
-'আমাকে এখানে নামিয়ে দে। আমি একটু রিক্সায় হাওয়া খেতে খেতে যাই।'
রায়হান রাস্তার এক পাশে বাইক থামালো।
-'তোর কাছে সিগারেট আছে?'
রায়হান পকেট থেকে সিগারেট বের করে দিলো। মুহিত সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হাত নেড়ে বললো-
-'খুব বড় একটা ফাঁড়া গেলো, তাই না?'
রায়হান হেলমেট খুলে ঘাম মুছলো-'তা ঠিক... অনেক বড় একটা বিপদ গেলো। মসজিদে কিছু টাকা দিয়ে দিতে হবে।'
-'একটা কথা বলবো?'
-'বল...'
-'দোস্ত, আমার এখনো কেমন যেন একটু ঘোর ঘোর লাগছে। তুই তো জানিস, এই জায়গায় আমি প্রতিদিন অফিসের গাড়ি থেকে নামি। বাকী রাস্তাটা রিক্সায় যাই। কেমন যেন মনে হচ্ছে, এই জায়গাটা আমার অচেনা। লাক্সের এই সাইনবোর্ডটা আমি প্রতিদিন দেখি, মেহজাবিনের বিজ্ঞাপন, আজকে সকালেও দেখেছি। কিন্তু এখন দেখছি এখানে অন্য সাইনবোর্ড! রাস্তার ওইপারে ফেয়ার এন্ড লাভলির একটা সাইনবোর্ড ছিলো, এখন দেখছি ফাঁকা হোর্ডিং। ঘটনা কি? আমি যা দেখছি, তুইও কি তাই দেখতেছিস?'
-'নয় এর ঘরের নামতা পড় তো?'
-'কেন?'
-'পড় না... দেখি মাথা ঠিক মতো কাজ করে কিনা।'
-'নয় একে নয়, নয় দুগুনে আঠারো, তিন নয়ে সাতাশ...'
-'সাত বারো কতো?'
-'চুরাশি'।
রায়হান হেসে ফেললো।
-'হুম মাথা তো মনে হয় ঠিক মতোই কাজ করছে। আর আমিও তো একই সাইনবোর্ড দেখতেছি। বড় একটা এক্সিডেন্ট গেছে তো, এইজন্যই হয়তো ঘোর ঘোর লাগছে। আমারও খুব টায়ার্ড লাগছে। তুই বাসায় যা। রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শোন, বাসায় পৌছে আমাকে একটা ফোন দিস।'
রায়হানের মাথার ভেতর কে যেন ফিস ফিস করে বললো-
-'ওকে ছেড়ো না। দু'জন একসাথে থাকো। ঝামেলা হয়ে যাবে... একসাথে থাকো...'
রায়হান এদিক-ওদিক মাথা ঝাঁকিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন হচ্ছে। বাসায় পৌছে ঘুমের ওষুধ খেয়ে কড়া একটা ঘুম দিতে হবে।
(তিন)
গ্যারেজের মেকানিক হালিম এক্সিডেন্টের কথা শুনে আর বাইকের অবস্থা দেখে আকাশ থেকে পড়লো-
-'আহারে স্যার, কন কি...এক্সিডেন হইছে কুনহানে? ব্যথা পাইছেন নি? নাহ... গাড়িটা ভালোই ক্ষতি হইছে... একপাশের রঙ পুরাই চইটা গেছে, হ্যান্ডেল ট্যাপ খাইছে, আর পিছনের লাইটটা পুরাই চেঞ্জ করতে হবে।
এই বলে কিছুটা থমকে গেলো। রায়হান বললো-
-'কি হইছে?'
-'স্যারে কি এর মইদ্দে লাইটসেট অন্য কুনুহান থাইক্কা লাগাইছিলেন? আপনের তো হিরো হাঙ্ক এর অরিজিনাল লাইট আছিলো, অহন তো দেহি, সুযুকির লাইটসেট লাগাইন্না...'
রায়হান বিরক্ত গলায় ধমকে উঠলো-
-'ওই মিয়া, তুমিই তো গত মাসে লাগায় দিছো। হাঙ্ক পাইলা না, তারপর সুযুকি লাগায় দিলা...'
মেকানিক হালিম বিড়বিড় করতে থাকলো-'কন কি বস? আমি কহন লাইটসেট চেঞ্জ করলাম?'
রায়হান রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে এলো। সুন্দর বাতাস হচ্ছে। মেঘ ডেকে উঠলো, সারারাত হয়তো বৃষ্টি হবে।
রায়হান ওর এপার্টমেন্টের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লিফট নামছে...লিফটের ডিসপ্লেতে উঠছে – ৮...৭...৬...৫...৪... রায়হানের খুব ঘুম পাচ্ছে। মাথার মধ্যে ফিসফিসানি এখন বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে কিন্তু কে কি বলছে স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
"টিং" করে মিষ্টি একটা আওয়াজ করে লিফট খুলে গেলো। রায়হান লিফটে ঢুকে পড়তেই মাথার ফিসফিসানি আরো জোরে-সোরে শোনা যেতে লাগলো। রায়হান দ্রুত ৬ নাম্বার বাটন টিপে দিলো। বাসায় যেয়েই ফ্যামিলি ডাক্তারকে ফোন করতে হবে। লিফটের দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগের মূহুর্তে দু'জন মাঝবয়সী লোককে প্রায় দৌড়ে লিফটের দিকে আসতে দেখা গেলো। ওদের মধ্যে একজন হাত তুলে লিফটের দরজা খোলা রাখতে ইশারাও করলো। রায়হান লিফট খোলা থাকার বাটন টেপার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে লিফট ওপরে উঠতে শুরু করলো। লিফটের বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে রায়হান গলার আওয়াজ শুনতে পেলো-
-'ধ্যাত... এখন আবার সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় উঠতে হবে।'
-'সব দোষ তোমার! এতো কাছ থেকে তোমার ডিভাইস কাজ করে না। ডিজগাস্টিং!'
-'চুপ থাকো!'
গলার শব্দ হারিয়ে গেলো। লিফট সাততলায় পৌছে গেছে।
রায়হান কলিং বেলে টিপে দেয়ালে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে। ভেতর থেকে ওর বড় মেয়ে চৈতি জিজ্ঞেস করলো-
-'কে?'
রায়হান ক্লান্ত গলায় বললো-'মামনি আমি, দরজা খোলো।'
চৈতি দরজা খুলে ওকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলো! রায়হান বুঝলো, ওর কপালের ছিলে যাওয়া দাগটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে, তাই অবাক হয়েছে। রায়হান হাত তুলে কিছুটা আশ্বস্ত করার ভংগিতে বললো-
-'চিন্তা করো না মামনি... ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে! আমি ঠিক আছি, শুধু কপালে একটু কেটে গেছে...'
চৈতির অবাক ভাব কিছুতেই কাটছেই না! সে যেন ভুত দেখেছে! রায়হান দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিতেই ও একটু পিছিয়ে গেলো। বাসার ভেতরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জোর গলায় ডাকলো-
-'মা, বাবা ... জলদি আসো...'
-'আরেহ... মাকে ডাকাডাকি করার দরকার নেই। কিছু হয়নি আমার... ছোট্ট এক্সিডেন্ট...কপালটা শুধু...'
বাসার ভেতরের করিডোর থেকে পুরুষালি ভরাট গলা ভেসে এলো-
-'চৈতি মামনি, কি হয়েছে? কে এসেছে?'
রায়হান চমকে উঠলো! করিডোরের ভেতরের দিকে তাকাতেই ওর মাথাটা আবারো বন করে ঘুরে উঠলো। চৈতি ভয় পেয়ে আরো এক ধাপ পিছিয়ে গেলো। করিডোরের মানুষটাও ভীষণ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হবারই কথা! মানুষটা আর একটু এগিয়ে রায়হানের সামনে এসে দাড়ালো।
রায়হানের গাঁ কেমন যেন গুলিয়ে উঠলো। কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে, অনেকটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন লাগে!
রায়হানের সামনে ঠিক যেন আরেকজন রায়হান দাঁড়িয়ে আছে!
এমন সময়। খোলা দরজা দিয়ে সেই লোক দু'জন হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
-'ধ্যাত, ঝামেলা হয়ে গেলো তো, ঠেকানো গেলো না। দু'জনের দেখা হয়েই গেলো। সব তোমার ডিভাইসের দোষ!!'
রায়হানের মাথার ভেতরটা আবারো ভীষণভাবে ঘুরে উঠলো! রায়হান দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারালো।