আপনাকে আমরা হারিয়েছি ৫ মে ২০১২ সালে। ৯ বছর হয়ে গেছে, এখনো প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ আপনার জন্য মন কাঁদে। যখন কোথায়ও যাই, খাসির রেজালা খাই, শুধু আপনাকেই মনে পড়ে। আমার জীবনে যেকোনো আনন্দ বা দুঃখের ঘটনা ঘটলেও আপনাকে আরও বেশি মনে পড়ে।
তখন আমি ছোট, আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। থাকতাম আজিমপুর কলনিতে। একদিন আপনার সঙ্গে বাসার কাছে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। হেঁটেই। হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে ছাতা ছিল না। আপনি আপনার শাড়ির আঁচল আমার মাথার ওপর দিয়ে জড়িয়ে রাখলেন আমাকে। আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে সারা জীবন এভাবে আপনি আপনার স্নেহমমতা, যত্ন আর ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে আগলে রেখেছেন।
বিকেলে আমরা আজিমপুর বড় মাঠে খেলতাম। বাবার নিয়ম ছিল আসরের আজানের পর খেলতে যাব আর মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেয়ে পড়তে বসব। আপনার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। তাই ছোটবেলা থেকেই আপনার লেখার ওপর হাত ঘুরাতাম, হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য।
বাসায় লেখার জন্য দিস্তা কাগজ আর স্কুলে লেখার জন্য ৪ আনা দামের খাতা কিনে দিতেন। মনে পড়ে মা, আপনি সেই দিস্তা কাগজ দিয়ে পাঁচ ভাইবোনের জন্য ৫টা খাতা সেলাই করে দিতেন।
আব্বা প্রতিদিন ফজর নামাজ পড়ে হাঁটতে যেতেন। ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে আসতেন। আপনি প্রতিদিন আমাদের জন্য মজার মজার খাবার তৈরি করতেন। স্কুলে যাওয়ার আগে গরম ঘি–ভাত, ডিমভাজি দিয়ে মেখে সবার মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। না খেয়ে কোনো দিন স্কুলে যেতে দিতেন না।
বাবা তখন সদর সাউথের এসডিও ছিলেন। সরকারি চাকরি। পাঁচ ভাইবোনের পড়াশোনা আর সংসারের খরচ চালাতে খুব কষ্ট হতো। আপনি আব্বার শার্ট ছিঁড়ে গেলে নিজে বসে সেলাই করে দিতেন। অনেক কষ্ট করেছেন, আমাদের বুঝতে দেননি।
আপনার পড়ার অনেক শখ ছিল। কিন্তু নবম শ্রেণিতে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাই সব সময় চাইতেন আমরা তিন বোন যেন মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করি। আপনার একটাই ইচ্ছা ছিল, আমরা যেন লেখাপড়ার পাশাপাশি সততা ও মানবিক মূল্যবোধ আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি। আমরা আপনার ইচ্ছা পূরণ করেছিলাম।
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব কাপড় সেলাই করতাম মেশিনে। খুব মনে পড়ে, তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমি আপনার ব্লাউজ সেলাই করে দিয়েছিলাম। কত কত যে দোয়া করেছিলেন দুহাত তুলে। মা, অনেক কথা মনে হয় আর ভীষণ কান্না পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে যেদিন চাকরি হলো, আপনার চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কী যে দোয়া করলেন। বললেন, 'অনেক বড় হও মা, অনেক বড়।' আপনার ও বাবার দোয়ায় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (সেবা ও সরবরাহ) পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলাম। কিন্তু মা আপনাকে জানানো হলো না। তার আগেই আপনি চলে গেলেন।
১৯৮৪ সালে আমি ফ্রান্স সরকারের স্কলারশিপ পেয়েছি শুনে আপনি যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। পিএইচডি শেষ করে ১৯৮৭ সালে যখন দেশে ফিরলাম, তখন আপনি ছুটে এলেন বাসায়। আপনার সেই আনন্দিত মুখ আমার চোখে ভাসে এখনো। আমাদের যেকোনো অর্জন মনে হতো আপনার নিজের অর্জন।
এখনো মনে পড়ে, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি পড়ছি। আব্বা রাজশাহীতে ডিসি হিসেবে কর্মরত। মালিবাগের বাসায় আপনার সঙ্গে আমি আর মিটন (ছোট বোন) ছিলাম। দুই ভাই তখন যার যার হোস্টেলে। হঠাৎ একদিন এক নতুন কাজের লোক এসে আমাদের সবাইকে ধুতরার বিষ খাইয়েছিল। দুধ আর রুটির মধ্যে ধুতরার পাউডারটা মেশানো ছিল। মাগো, আপনি তো মরেই যাচ্ছিলেন। ডাক্তার বলেছিলেন, আপনার বমি না হলে বাঁচানো সম্ভব নয়। ২-৩টা ইনজেকশন দেওয়ার পর বমি হয়েছিল। কী যে এক বিভীষিকাময় রাত ছিল সেদিন। আপনার চেহারা নীল হয়ে গিয়েছিল। দিনের পর দিন আপনার পাশে বসে জেগেছিলাম। ডাক্তারের নির্দেশমতো একটু পরপর আপনার জিবে ফোঁটা ফোঁটা পানি আর ওষুধ দিতাম। কথা বলতে আপনার খুব কষ্ট হতো। দুই হাত তুলে শুধু দোয়া করতেন। মাঝেমধ্যে আমাকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলতেন, 'কিরে মা, এখনো জেগে আছিস?' কী করে বোঝাব মা, আপনার অবস্থাটা তখন কেমন ছিল। সেবার বেঁচেই ফিরেছিলেন।
আমরা ভাইবোন সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি বড় বড় পোস্টে কাজ করেছি। সবই আপনার আর আব্বার অবদান। আপনি শুধু আমাদের মা ছিলেন না। এলাকার গরিব আত্মীয়স্বজনের অনেকের মা ছিলেন। অনেকের ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করতে সাহায্য করেছেন। তাঁরা অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। আপনি চলে যাওয়ার পর অনেকের কাছ থেকে আপনার কথা শুনেছি। আপনি মানুষের জন্য মানুষের কল্যাণে অনেক কিছু করেছেন। আমার প্রাণপ্রিয় মা, আপনার মতো মা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা।
* লেখক: ড. শামসুন নূর | সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর।