What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নুরজাহান, (ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
নূরজাহান – ইমদাদুল হক মিলন



১.০১

শেষ হেমন্তের অপরাহ্ন বেলায় উত্তরের হাওয়াটা একদিন বইতে শুরু করল।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘরের ছায়ায় বসেছে দবির গাছি, হাওয়াটা গায়ে লাগল। গা কাঁটা দিয়ে উঠল। পলকে দিশাহারা হল সে। বুকের ভিতর আনচান করে উঠল। যেন উত্তরের হাওয়া বুকের ভিতরও ঢুকে গেছে তার, ঢুকে তোলপাড় করে দিয়েছে সব।

খাওয়া দাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে তামাক খায় দবির। রান্নাচালায় বসে গুছিয়ে, সুন্দর করে তামাক সাজিয়ে দেয় নূরজাহান আর নয়তো তার মা। নূরজাহান এখন বাড়িতে নাই। ঢাকা থেকে অনেক উঁচু হয়ে একটা সড়ক আসছে বিক্রমপুরের দিকে। মেদিনীমণ্ডলের পাশ দিয়ে মাওয়া হয়ে সেই সড়ক চলে যাবে খুলনায়। মাওয়ার পর রাজকীয় নদী পদ্মা। সড়কের মাঝখানে নিজের মহিমা নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকবে পদ্মা, তবু এই সড়কের নাম ঢাকা খুলনা মহাসড়ক। বিরাট একটা কারবার হচ্ছে দেশগ্রামে। কত নতুন নতুন চেহারা যে দেখা যাচ্ছে! নানান পদের মানুষে ভরে গেছে গ্রামগুলি। একটা মাত্র সড়ক রাতারাতি বদলে দিচ্ছে বিক্রমপুর অঞ্চল। শহরের হাওয়া লেগে গেছে গ্রামে। যেন গ্রাম এখন আর গ্রাম না, যেন গ্রাম হয়ে উঠছে শহর। হাজার হাজার মানুষ লেগে গেছে সড়কের কাজে। ফাঁক পেলেই সেই সড়ক দেখতে চলে যায় নূরজাহান।

আজও গেছে।

নাকেমুখে দুপুরের ভাত গুঁজে শিশুর মতো ছটফট করে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। মা বাবা কারও দিকে তাকিয়েও দেখেনি। এই ফাল্গুনে তেরো হবে নূরজাহানের। তাকে দেখায় বয়সের চেয়ে বড়। নূরজাহানের শরীর বাড়ন্ত। সীতারামপুরের হাতপাকা কারিগরদের বোনা ডুরেশাড়ি পরছে দুই বছর হল। শাড়ি পরলে বাড়ন্ত শরীরের কিশোরী চোখের পলকে যুবতী হয়ে যায়। তেমন যুবতী নূরজাহান হয়েছে দুই বছর আগে।

তবে মনের দিক দিয়ে, আচার আচরণ কথাবার্তা চালচলনে নূরজাহান শিশু। সারাক্ষণ মেতে আছে গভীর আনন্দে। গরিব গিরস্থ ঘরে জন্মে এত আনন্দ কোথায় যে পায় মানুষ!

বাড়ির উঠান পালান (আঙিনা) মাতিয়ে নূরজাহান যখন চলাফিরা করে মনে হয় না সে রক্ত মাংসের মানুষ। মনে হয় চঞ্চল পাখি।

কথায় কথায় খিলখিল করে হাসে নূরজাহান। নূরজাহানের হাসি হাসি মনে হয় না।

.

১.০২

বর্ষার মুখে পদ্মার ফুলে ওঠা পানি যখন খাল বেয়ে গ্রামে ঢোকে, এক পুকুর ভরে পানি যখন অন্য পুকুরে ঢোকার জন্য উঁকিঝুঁকি মারে, জোয়ারে মাছের লোভে দুই পুকুরের মাঝখানে যখন সরু নালা কেটে দেয় চতুর মানুষ, সেই নালা ধরে এক পুকুরের পানি যখন গিয়ে লাফিয়ে পড়ে অন্য পুকুরে, পানির সঙ্গে পানির মিলন, তখনকার যে শব্দ, নূরজাহানের হাসি তেমন। শস্যের চকমাঠ ভেঙে নূরজাহান যখন ছোটে, নূরজাহানের ছুটে যাওয়াও জোয়ারে মাছের মতো, চোখের পলকে আছে, চোখের পলকে নাই।

এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে কখনও কখনও মন উদাস হয় দবিরের। দুইদিন পর বিয়াশাদি হবে মেয়ের, কোথাকার কোন সংসারে গিয়ে পড়বে! কেমন হবে সেই সংসারের মানুষ! হাত পায়ে শিকল বেঁধে মেয়েটাকে হয়তো তারা খাঁচার পাখি বানিয়ে ফেলবে। ইচ্ছা করলেও সেই শিকল ছিঁড়তে পারবে না নূরজাহান। আস্তে ধীরে এই মুক্ত জীবনের কথা ভুলে যাবে, অভ্যস্ত হবে বন্দি জীবনে।

এইসব ভেবে মেয়েকে কখনও শাসন করে না দবির। মেয়ের মাকেও কিছু বলতে দেয় না। ফলে নূরজাহান আছে নূরজাহানের মতো।

আজ দুপুরের পর, নূরজাহান বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরের ছায়ায় বসে নূরজাহানের কথাই ভাবছিল দবির আর তামাকের অপেক্ষা করছিল। তখনই উত্তরের হাওয়াটা এল। সারাবছর এই হাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে দবির। এক শীত শেষ হলে শুরু হয় আরেক শীতের অপেক্ষা। কবে আসবে শীতকাল, কবে বইবে উত্তরের হাওয়া। কবে উত্তরের হাওয়ায় গা কাঁটা দিবে দবির গাছির, বুকের ভিতর তোলপাড় করবে। কবে উত্তরের হাওয়ায় কানের কাছে শন শন করবে খাজুরের অবোধ পাতা। দেশগ্রামের রসবতী খাজুরগাছ ডাক পাঠাবে।

আজ সেই ডাক পেল দবির, পেয়ে দিশাহারা হল। এত যে প্রিয় তামাক, খাওয়া দাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে তামাক না খেলে মনেই হয় না ভাত খাওয়া হয়েছে, খেয়ে পেট ভরেছে, সেই তামাকের কথা একদম ভুলে গেল। নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়াল। খাজুরগাছ ঝুড়ার ঠুলই আছে ঘরের পশ্চিম দিককার খামের সঙ্গে ঝুলানো। তিনচার বছরের পুরানা জিনিস। তবু এখনও বেশ মজবুত। শীতকাল শেষ হওয়ার লগে লগে যত্ন করে খামের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে দবির। ঠুলইয়ের ভিতর থাকে ছ্যান কাটাইল আর কাঠের একটা আতুর (হাতুড়ি)। আতুর দেখবার দরকার হয় না। ছ্যান কাটাইল দেখতে হয়। বর্ষাকালে যখন নিঝুম হয়ে নামে বৃষ্টি, টানা দুইদিন তিনদিন যখন বৃষ্টি থামার নামগন্ধ থাকে না, তখন ছ্যান কাটাইলে জং ধরার সম্ভাবনা। দবির মাঝে মাঝেই তখন জিনিসগুলো বের করে। অলস ভঙ্গিতে বালিকাচায় ঘষে ঘষে ধার দিয়ে রাখে ছ্যান কাটাইলে।

বর্ষা শেষ হওয়ার পর তো আর কথাই নাই। কী শরৎ কী হেমন্ত দুইদিন একদিন পর পরই বালিকাচা নিয়ে বসে দবির। মন দিয়ে বালিকাচায় ঘষে যায় ছ্যান কাটাইল।

কাল বিকালেও কাজটা সে করেছে। তখন কে জানত একদিন পরই উত্তরের হাওয়ায় গিরস্তবাড়ির বাগান আঙিনা থেকে রসবতী খাজুরগাছেরা তাকে ডাক পাঠাবে!

ঘরে ঢুকে চঞ্চল হাতে ঠুলই নিল দবির। বাতার সঙ্গে গুঁজে রাখা মাজায় বান্ধার (কোমরে বাঁধার) মোটা কাছি নিল। আদ্যিকালের উঁচু চকির (চৌকির) তলায় যত্নে রাখা আছে রসের দশ বারোটা হাঁড়ি, হাঁড়ির সঙ্গে বাঁশের বাখারির ভার। আশ্চর্য এক নেশায় আচ্ছন্ন মানুষের মতো জিনিসগুলো বের করল দবির। লুঙ্গি কাছা মেরে মাজার পিছনে, ডানদিকে ঝুলাল ঠুলই। তারপর ভারের দুইদিকে হাড়িগুলি ঝুলিয়ে, কাছি মাফলারের মতো গলায় প্যাচিয়ে ঘর থেকে বের হল। খানিক আগে ঘরের ছায়ায় বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে এখনকার এই মানুষটার কোনও মিল নাই।

ঘর থেকে বের হয়েই বাড়ির নামার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে দবির। তার মেয়ের মা হামিদা তখন হুঁকা নিয়ে ছুটে আসছিল, এসে দেখে স্বামী গাছ ঝুড়তে যায়। তামাক খাওয়ার কথা তার মনে নাই। ফ্যাল ফ্যাল করে নামার দিকে হেঁটে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়েছে সে। ঠিক তখনই উত্তরের হাওয়া এসে মুখে ঝাঁপটা দিল। অদ্ভুত এক আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল হামিদার। রসের দিন আইয়া পড়ছে, সংসারে অহন আর কোনও অভাব থাকবো না।

.

১.০৩

ঢোল কলমির গাঢ় সবুজ পাতায় লাল রঙের লম্বা একটা ফড়িং বার বার বসছে, বার বার উড়াল দিচ্ছে। ফড়িংটার দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বলল, ও কনটেকদার সাব আপনেগো রাস্তা শেষ অইব কবে?

লোকটার নাম আলী আমজাদ। সাব কন্ট্রাক্টে মাটি কাটার কাজ করছে। সড়কের দুইপাশ থেকে মাটি কেটে তুলছে তার শতখানেক মাটিয়াল। আলী আমজাদ লেবার কন্ট্রাক্টর। নিজের মাটিয়াল নিয়ে মূল কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে করছে। লাভ ভালই থাকে। কাজ শুরুর কয়দিন পরই ফিফটি সিসির সেকেন্ডহ্যান্ড একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেলেছে। সেই মোটর সাইকেল নিয়ে সাইটে আসে। গলায় জড়ানো থাকে খয়েরি রঙের মাফলার। রোদে পোড়া কালা কুচকুচা গায়ের রঙ। ছেলেবেলায় বসন্ত হয়েছিল। গালে মুখে বসন্তের দাগ রয়ে গেছে। চোখ কুতকুতা আলী আমজাদের, শরীর দশাসই। টেটরনের নীলপ্যান্ট পরে থাকে আর সাদাশার্ট। সড়কের কাজ পাওয়ার পর হুঁড়ি বেড়েছে, পেটের কাছে শার্ট এমন টাইট হয়ে থাকে, দেখতে বিচ্ছিরি লাগে।

আলী আমজাদ ঘড়ি পরে ডানহাতে। কালা কুচকুচা লোমশ হাতে সাদা চেনের ঘড়ি বেশ ফুটে থাকে। আর তার সামনের পাটির একটা দাঁত সোনায় বাঁধানো। হাসলে মনে হয় অন্ধকার মুখের ভিতর কুপির আলো পড়েছে।

নূরজাহানের কথা শুনে হাসল আলী আমজাদ। তার হাসি দেখে আলী আমজাদকে কী জিজ্ঞাসা করেছিল ভুলে গেল নূরজাহান। আলী আমজাদের সোনায় বাঁধানো দাঁতের দিকে তাকিয়ে বলল, সোনা দিয়া দাঁত বান্দাইছেন ক্যা? হাসলে মনে অয় ব্যাটারি লাগাইয়া হাসতাছেন।

মেয়েদের কাছে এরকম কথা শুনলে লজ্জায় যে কোনও পুরুষের মুখ নিচু হয়ে যাবে। আলী আমজাদের হল না। প্রথমে হেসেছিল নিঃশব্দে, ঠোঁট ছড়িয়ে। এবার খে খে করে হাসল। দাঁত না থাকলে বান্দামু না?

কথার লগে মুখ থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ এল। দিনের পর দিন দাঁত না মাজলে এরকম গন্ধ হয় মুখে।

আলী আমজাদের মুখের গন্ধে উকাল (বমি) এল নূরজাহানের। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থু করে ছ্যাপ (থুতু) ফেলল। আগের দুইটা প্রশ্নই ভুলে গেল। প্রচণ্ড ঘৃণায় নাক মুখ কুঁচকে বলল, ইস আপনের মুখে এমুন পচা গন্দ ক্যা? দাঁত মাজেন না?

একথায়ও লজ্জা পেল না আলী আমজাদ। আগের মতোই খে খে করে হাসল। তিনখান কথা জিগাইছো। কোনডার জব (জবাব) দিমু?

আলী আমজাদ কথা শুরু করার আগেই বেশ কয়েক পা সরে দাঁড়িয়েছে নূরজাহান। যেন তার মুখের গন্ধ নাকে এসে না লাগে। ব্যাপারটা বুঝল আলী আমজাদ। বুঝেও গা করল না। বলল, কইলা না?

কী কমু?

কোন কথার জব দিমু আগে?

আপনের যেইডা ইচ্ছা।

বুক পকেট থেকে ক্যাপস্টান সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল আলী আমজাদ, ম্যাচ বের করল। সিগ্রেট ধরিয়ে হাওয়ায় ধুমা (ধোঁয়া) ছেড়ে বলল, কনটেকদারের কাম অইলো লেবারগো লগে কথা কওয়া, ধমক দেওয়া, গাইল দেওয়া। গাইল না দিলে লেবাররা কোনওদিন ঠিক মতন কাম করে না। যেই কনটেকদার লেবারগো যত বেশি গাইল দিতে পারবো সে তত বড় কনটেকদার। আমি সকাল থিকা লেবারগো গাইল্লাইতে থাকি। গাইল্লাইতে গাইল্লাইতে মুখে দুরগন্দ (দুর্গন্ধ) অইয়া যায়।

আবার সিগ্রেটে টান দিল আলী আমজাদ। খে খে করে হাসল। তয় মাইনষের মুখের গন্দও কইলাম কোনও কোনও মাইনষে পছন্দ করে।

ভুরু কুঁচকে আলী আমজাদের মুখের দিকে তাকাল নূরজাহান। কী?

হ। আমার মুখের এই গন্দ তোমার ভাবীছাবে বহুত পছন্দ করে।

নূরজাহান আবার ছ্যাপ ফেলল। আপনের বউ তো তাইলে মানুষ না। পেতনি, পেতনি।

বুড়া মতন একজন মাটিয়াল মাথায় মাটির য়োড়া (ঝুড়ি) নিয়ে সড়কের উপর দিকে উঠছিল। বোঝা তার তুলনায় ভারী। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যখন তখন উপুড় হয়ে পড়বে। হলও তাই। আলী আমজাদ আর নূরজাহানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হুড়মুড় করে পড়ল। লগে লগে ডানপা উঠে গেল আলী আমজাদের। জোরে লোকটার কোকসায় একটা লাথথি মারল। অশ্লিল একটা বকা দিল। বোরা জন্তুর মতো ভয়ে সিটকে গেল লোকটা। কাচুমাচু ভঙ্গিতে য়োড়া তুলে নামার দিকে নেমে গেল। কয়েক পলকের মধ্যে ঘটল ঘটনা। নূরজাহান বোবা হয়ে গেল।

আলী আমজাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে নূরজাহানের দিকে তাকাল। হাসল। কী বোজলা? এইডা আসলে ছোট্ট একখান নমুনা দেখলা। তুমি সামনে আছিলা দেইক্কা মাত্র একটা লাথি দিছি। তুমি না থাকলে লাইথথাইয়া নিচে হালাইয়া দিতাম শালারে। শালায় ইচ্ছা কইরা বোঝা হালাইছে। য্যান অর য়োড়ায় কম মাডি দেওয়া অয়। আরামে আরামে কাম করতে পারে। আমার লগে এই হগল চালাকি চলে না। এই পড়া আমি বহুত আগে পইড়া থুইছি।

ভিতরে ভিতরে রাগে তখন ফেটে যাচ্ছে নূরজাহান। বাপের বয়সী একটা লোককে এমন লাথি মারতে পারে কেউ!

দাঁত কটমট করে নূরজাহান বলল, আপনে একটা খবিস। আপনে মানুষ না।

আমার জাগায় তুমি অইলে তুমিও এমুন করতা।

না করতাম না। যাগো দিলে রহম আছে তারা এমুন কাম করে না।

আমার দিলে নাই। নিজের লেইগা সব করতে পারি আমি।

করেন আপনের যা ইচ্ছা। আমি যাই।

নূরজাহান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আলী আমজাদ বলল, কই যাইবা?

গেরামে ঘুইরা ঘাইরা বাইত্তে যামু।

গেরামে ঘোরনের কাম কী? এহেনেই থাকো, তোমার লগে গল্প করি।

আপনে মনে করছেন রোজ রোজ সড়কে আমি আপনের লগে গল্প করতে আহি?

আলী আমজাদ সিগ্রেটে টান দিয়ে বলল, তয় ক্যান আহো?

আহি সড়ক দেকতে। মানুষজন দেকতে। সড়ক কতাহানি (কতখানি) অইলো না অইলো দেইক্কা যাই। কাইল থিকা আপনের সামনে আর আমু না। অন্য দিকদা সড়ক দেইক্কা যামু গা। আপনে মানুষ ভাল না।

আলী আমজাদ আবার হাসল। এইডা ঠিক কথা কইছো। আমি মানুষ ভাল না। বহুত বদ মানুষ আমি। যা ভাবি সেইটা কইরা ছাড়ি। টেকা পয়সা জান পরান কোনও কিছুর মায়া তহন আর করি না।

আলী আমজাদের কথা শুনে এই প্রথম ভয়ে বুক কেঁপে উঠল নূরজাহানের। অকারণে শাড়ি বুকের কাছে টানল। জড়সড় হয়ে গেল।

ব্যাপারটা খেয়াল করল আলী আমজাদ। হাসল। হাতের সিগ্রেট শেষ হয়ে আসছে। সিগ্রেটে শেষটান দিল। তারপর টোকা মেরে ফেলে দিল। আড়চোখে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে চটপটা গলায় বলল, এতক্ষুণ ধইরা নানান পদের প্যাচাইল পাড়লাম তোমার লগে, এইবার ভালকথা কই। তুমি আমার দাঁতের কথা জিগাইছিলা। সামনের একখান দাঁত পোকে খাইয়া হালাইছিলো। তহন নিজে কনটেকদারি করি না, ঢাকার বড় এক কনটেকদারের ম্যানাজারি করি। সে কইলো দাঁতের ডাক্তরের কাছে যাও, দাঁত ঠিক কইরা আহো। ডাক্তরের কাছে গেলাম, পোকড়া দাঁত হালাইয়া এই দাঁত লাগাইয়া দিলো। চাইছিলো পাথথরের দাঁত লাগাইতে, কম খরচে অইয়া যায়। আমি কইলাম, না সোনা দিয়াই বান্দান। তহন সোনার দামও কম আছিলো। আইজ কাইল তো সোনার বহুত দাম। এই দাঁতটাও দামি অইয়া গেছে।

আলী আমজাদ হাসল। এই দাঁত অহন আমার সম্পদ। বিপদ আপদে পড়লে খুইল্লা বেইচ্চা হালাইলে ভাল টেকা পামু।

নূরজাহান ঠাট্টার গলায় বলল, বেচনের আগে ভাল কইরা মাইজ্জা লইয়েন। এই রকম পচা গন্দ থাকলে সোনারুরা দাঁত কিনবো না।

আলী আমজাদ আবার হাসল। টেকা আর সোনার পচা গন্দরে গন্দ মনে করে না মাইনষে। হাতে পাইলেঐ খুশি অয়। পচা গন্দরে মনে করে আতরের গন্দ।

বাদ দেন এই সব প্যাচাইল। আমি যাই।

আড়চোখে আবার নূরজাহানকে দেখল আলী আমজাদ। কথা অন্যদিকে ঘুরাল। সড়কের কাম কবে শেষ অইবো হুইন্না যাইবা না?

নূরজাহান উদগ্রীব হয়ে আলী আমজাদের মুখের দিকে তাকাল। কবে?

দুইতিন মাসের মইধ্যে।

তারবাদে এই রাস্তা দিয়া গাড়ি চলবো?

তয় চলবো না? না চললে রাস্তা বানানের কাম কী?

কী গাড়ি চলবো?

বাস টেরাক মিনিবাস বেবিটেসকি।

আমগো গেরাম থিকা ঢাকা যাইতে কতক্ষুণ লাগবো?

ঘণ্টাহানি।

কন কী?

হ। তুমি ইচ্ছা করলে দিনে দুইবার ঢাকা গিয়া দুইবার ফিরত আইতে পারবা। অহন তো বিয়ানে মাওয়ার ঘাট থিকা লঞ্চে উটলে ঢাকা যাইতে যাইতে বিয়াল অইয়া যায়! ছিন্নগর (শ্রীনগর) দিয়া গেলে আরও আগে যাওন যায়। তয় হাঁটতে অয় অনেক।

আলী আমজাদের শেষ দিককার কথা আর কানে গেল না নূরজাহানের। আনমনা হয়ে গেল সে। স্বপ্নমাখা গলায় বলল, রাস্তা অইয়া যাওনের পর বাসে চইড়া ঢাকা যামু আমি। ঢাকার টাউন দেখনের বহুত শখ আমার।

বিকালবেলার চমৎকার এক টুকরা আলো এসে পড়েছে নূরজাহানের মুখে। সেই আলোয় অপূর্ব লাগছে মেয়েটিকে। তার শ্যামলা মিষ্টি মুখখানি, ডাগর চোখ, নাকফুল আর স্বপ্নমাখা উদাসীনতা কী রকম অপার্থিব করে তুলেছে তাকে। কুতকুতা চোখে মুগ্ধ হয়ে নূরজাহানকে দেখছে আলী আমজাদ। দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে যে ভিতরে তার জেগে উঠতে চাইছে এক অসুর, খানিক আগেও আলী আমজাদ উদিস (টের) পায়নি।

ঠিক তখনই হা হা করা উত্তরের হাওয়াটা এল। সেই হাওয়ায় আলী আমজাদের কিছু হল না, নূরজাহানের কিশোরী শরীর অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে ভরে গেল। কোনওদিকে না তাকিয়ে ছটফট করে সড়ক থেকে নামল সে। শস্যের চকমাঠ ভেঙে, ভ্রূণ থেকে মাত্র মাথা তুলেছে সবুজ ঘাসডগা, এমন ঘাসজমি ভেঙে জোয়ারে মাছের মতো ছুটতে লাগল।

.

১.০৪

মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণের নামায় এলোমেলো ভাবে ছড়ানো আটখানা খাজুর গাছ। সব কয়টা গাছই নারীগাছ। পুরুষগাছ নাই একটাও। নারী গাছে খাজুর ধরে, পুরুষ গাছে ধরে না। দুইরকম গাছের রসও দুইরকম। পুরুষ গাছের রস হয় সাদা। তেমন মিঠা না। নারী গাছের রস হালকা লাল। ভারি মিঠা। ভরা বর্ষায় গাছগুলির মাজা পর্যন্ত ওঠে পানি। কোনও কোনও বর্ষায় মাজা ছাড়িয়ে বুক ছুঁই ছুঁই। এবারের বর্ষা তেমন ছিল না। গাছগুলির মাজা ছুঁয়েই নেমে গেছে। ফলে প্রায় প্রতিটা গাছেরই মাজার কাছে সচ্ছল গিরস্ত বউর বিছার মতো লেগে আছে পানির দাগ। বয়সের ভারে নৌকার মতো বেঁকা হয়েছে যে গাছটা, বর্ষার পানি তারও পিঠ ছুঁয়েছিল। সারাবর্ষা পিঠ ছুঁয়ে থাকা পানি ভারি সুন্দর একখানা দাগ ফেলে গেছে পিঠে। এই গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর আনন্দে শ্বাস ফেলল দবির। বহুকাল পর প্রিয় মানুষের মুখ দেখলে যেমন হয়, বুকের ভিতর তেমন অনুভূতি। ভারের দুইদিকে ঝুলছে দশ বারোটা হাঁড়ি। সাবধানে ভারটা গাছতলায় নামাল সে। তারপর শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে গেল। একবার এই গাছের গায়ে পিঠে হাত বুলায়, আরেকবার ওই গাছের। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলে, মা মাগো, মা সগল, কেমুন আছো তোমরা? শইল ভাল ভো? কেঐর কোনও ব্যারাম আজাব নাই তো, বালা মসিবত নাই তো?

উত্তরের হাওয়ায় শন শন করে খাজুরডগা। সেই শব্দে দবির শোনে গাছেরা তার কথার পিঠে কথা বলছে। ভাল আছি বাজান, ভাল আছি। ব্যারাম আজাব নাই, বালা মসিবত নাই।

বর্ষাকাল শেষ হওয়ার লগে লগে খাজুরতলায় জন্মেছে টিয়াপাখি রঙের বাকসা ঘাস। কার্তিকের কোনও এক সময় সাতদিনের জন্য নামে যে বৃষ্টি, লোকে বলে কাইত্তানি, এবারের কাইত্তানির ধারায় রাতারাতি ডাঙ্গর (ডাগর) হয়েছে বাকসা ঘাস। এখন মানুষের গুড়মুড়া (গোড়ালি) ডুবে যাওয়ার মতন লম্বা। এই ঘাস ছেঁয়ে আছে মরা খাজুরডগায়। গাছের মাথায় মরে যাওয়ার পর আপনা আপনি খসে পড়েছে তলায়। পাতাগুলি খড়খড়া শুকনা কিন্তু কাঁটাগুলি শুকিয়ে যাওয়ার পরও কাঁটা। টেটার নালের মতো কটমট করে তাকিয়ে আছে। যেন তাদের আওতায় এলেই কারও আর রক্ষা নাই। খাজুরতলায় পা দিলেই সেই পা ফুটা করে শরীরে ঢুকবে, ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে কাঁটাফোটা জায়গায় কাঁথা সিলাবার সুই দিয়ে যতই ঘাটাঘাটি করুক, খাজুরকাঁটার তীক্ষ্ণ ডগার হদিস মিলবে না। সে মিশে যাবে রক্তে। রগ ধরে সারা শরীর ঘুরে বেড়াবে। দেড় দুইমাস পর বুক পিঠ ফুটা করে বের হবার চেষ্টা করবে। প্রচণ্ড ব্যথায় মানুষের তখন মরণদশা। কেউ কেউ মরেও।

সীতারামপুরের পুষ্প ঠাইরেনের (ঠাকরুনের) একমাত্র ছেলে মরেছিল খাজুরকাটায়। দুরন্ত স্বভাবের ছেলে ছিল। শীতের রাতে ইয়ার দোস্তদের নিয়া রস চুরি করতে গেছে কুমারভোগে। টর্চ মেরে মেরে এইগাছ থেকে হাড়ি নামায়, ওইগাছ থেকে নামায়। তারপর গাছতলায় দাঁড়িয়েই হাঁড়িতে চুমুক। কারও কিছু হল না, ফিরবার সময় ঠাইরেনের ছেলের ডানপায়ে ফুটল কাটা। এক দুইদিন ব্যথা হল পায়ে। ঠাইরেন নিজে সুই দিয়ে ঘাটাঘাটি করল ছেলের পা। কাঁটার দেখা পেল না। চার পাঁচদিনের মাথায় মা ছেলে দুইজনেই ভুলে গেল কাঁটার কথা। দেড়মাস পর এক সকালে পিঠের ব্যথায় চিৎকার শুরু করল ছেলে। কোন ফাঁকে শরীর অবশ হয়ে গেছে। না নড়তে পারে, না বিছানায় উঠে বসতে পারে। শবরীকলা রঙের মুখখানা সরপুটির পিত্তির মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠাইরেন কিছু বুঝতে পারে না, দিশাহারা হয়ে ডাক্তার কবিরাজ ডাকে, ফকির ফাকরা ডাকে। হোমিপ্যাথি এলাপ্যাথি, পানিপড়া, তাবিচ কবচ, হেকিমি আর কতপদের যে টোটকা, কিছুতেই কিছু হল না। পাঁচদিন ব্যথায় ছটফট করল ছেলে তারপর বিয়ানরাতের দিকে মারা গেল। পিঠের যেখানটায় ব্যথা হচ্ছিল সেই জায়গা থকথক করছে। দেখেই বোঝা যায় মাংসে পচন ধরেছে। লাশ নাড়াচাড়ার সময় চাপ পড়েছিল, চামড়া ফেটে গদ গদ করে বের হল রোয়াইল ফলের মতো রং, এমন পুঁজ। সেই পুঁজের ভিতর দেখা গেল মাথা উঁচু করে আছে একখানা খাজুরকাঁটা।

এটা অনেককাল আগের কথা। তারপর থেকে দেশগ্রামে আর রস চুরি হয় না। লোকে মনে করে খাজুরগাছ মা জননী। মা যেমন বুকের দুধ সন্তানের জন্য লুকিয়ে রাখে, খাজুরগাছ তেমন করে রস লুকিয়ে রাখে গাছির জন্য। গাছি ছাড়া অন্য কেউ এসে বুকে মুখ দিলে কাঁটার আঘাতে মা জননী তার এসপার ওসপার (এপার ওপার) করেন, জান নেন। নাহলে এই যে এতকালের পুরানা গাছি দবির, বয়স দুইকুড়ির কাছাকাছি, গাছ ঝুড়ছে পোলাপাইন্যা কাল (বালক বয়স) থেকে, কই তার পায়ে তো কখনও কাঁটা বিনলো (ফুটল) না! গাছ ঝুড়তে উঠে কাঁটার একটা খোঁচাও তো সে কখনও পায়নি!

এইসব ভেবে নৌকার মতো বেঁকা হয়ে থাকা গাছটার পায়ের কাছে বিনীত ভঙ্গিতে দুইহাত ছোঁয়াল দবির। তিনবার সালাম করল গাছটাকে। বহুকাল পর মায়ের কাছে ফিরে আসা আদুরে ছেলে যেমন করে ঠিক তেমন আকুলি বিকুলি ভঙ্গিতে গাছটাকে তারপর দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, মা মাগো, আমার মিহি (দিকে) ইট্টু নজর রাইখো মা। গরিব পোলাডার মিহি নজর রাইখো। এই দুইন্নাইতে তোমরা ছাড়া আমার মিহি চাওনের আর আছে কে! তোমরা দয়া না করলে বাচুম কেমতে! আমি তো হারা বচ্ছর তোমগো আশায় থাকি। তোমগো দয়ায় দুই তিনটা মাস সুখে কাটে। আরবছর (আগের বছর) ভালই দয়া করছিলা। এইবারও তাই কইরো মা। মাইয়া লইয়া, মাইয়ার মারে লইয়া বছরডা য্যান খাইয়া পইরা কাটাইতে পারি।

.

১.০৫

ছনুবুড়ির স্বভাব হচ্ছে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর টুকটাক চুরি করা, মিথ্যা বলা। কূটনামিতে তার কোনও জুড়ি নাই। বয়স কত হয়েছে কে জানে! শরীরটা কঞ্চির ছিপআলা বড়শিতে বড়মাছ ধরলে টেনে তোলার সময় যেমন বেঁকা হয়ে যায় তেমন বেঁকা হয়েছে। যেন এই শরীর তার নরম কঞ্চির ছিপ, মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা বয়স নামের মাছ ছিপের সঙ্গে শক্ত সুতায় ঝুলিয়ে দেওয়া বড়িশির আধার (টোপ) গিলে ভাল রকম বেকায়দায় পড়েছে। দিশাহারা হয়ে মাছ তাকে টানছে, টেনে বেঁকা করে ফেলছে। কোন ফাঁকে ভেঙে পড়বে ছিপ কেউ জানে না। টানাটানি চলছে। আর এই ফাঁকেই নিজের মতো করে জীবনটা চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি। এই গ্রাম সেই গ্রাম ঘুরছে, এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘুরছে, চুরি করছে, মিথ্যা বলছে। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে, ছনুবুড়ি আছে ভাল। মাথায় পাটের আঁশের মতো চুল, মুখে একটাও দাঁত নাই, একেবারেই ফোকলা, শরীরের চামড়া খরায় শুকিয়ে যাওয়া ডোবানালার মাটির মতো, পরনে আঠাইল্লা (এঁটেল) মাটি রঙের থান, হাতে বাঁশের একখানা লাঠি আর দুইচোখে ছানি নিয়ে কেমন করে যে এইসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি, ভাবলে তাজ্জব লাগে।

আজ দুপুরে সড়কের ওপাশে, পুব পাড়ার জাহিদ খাঁর বাড়ি গিয়েছিল ছনুবুড়ি। জাহিদ খাঁর ছেলের বউদের অনুনুয় করে দুপুরের ভাতটা সেই বাড়িতেই খেয়েছে। খেয়ে ফিরার সময় ছানিপড়া চোখেই দেখতে পেয়েছে বাড়ির পিছন দিককার তরিতরকারির বাগানে বাইগন (বেগুন) ধরেছে, টমাটু (টমেটো) ধরেছে। এখনও ডাঙ্গর হয়নি বাইগন, টমাটুগুলি ঘাসের মতো সবুজ, লাল হতে দিন দশবারো লাগবে। তবু চুরির লোভ সামলাতে পারেনি। বার দুই তিনেক এদিক ওদিক তাকিয়ে টুকটুক করে দুই তিনটা বাইগন ছিঁড়েছে, চার পাঁচটা টমাটু ছিঁড়েছে। তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে হাঁটা দিয়েছে।

সার্থকভাবে চুরি করবার পর মনে বেদম ফুর্তি থাকে ছনুবুড়ির। এমনিতেই দুপুরের খাওয়াটা হয়েছে ভাল, ঢেকিছাটা লক্ষ্মীদিঘা চাউলের ভাত আর খইলসা (খলিসা) মাছের সালুন (ঝোল), তার ওপর সার্থক চুরি, ছনুবুড়ির স্বভাব জেনেও বাড়ির কেউ উদিস পায়নি, পথে নেমে বুড়ি আহল্লাদে একেবারে আটখানা। বাইগন টমাটু টোপরে (কোচর) নিয়ে সন্তানের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে বুকের কাছে আর হাঁটছে খুব দ্রুত। চুরি করে বের হয়ে আসার পর ছনুবুড়ি হাঁটে একেবারে ছেমড়ির (ছুঁড়ির) মতো। বয়স নামের জুয়ান মাছটা টেনে তখন তাকে কাবু করতে পারে না।

আজও পারেনি। দ্রুত হেঁটে প্রথমে ছনুবুড়ি গেছে হাজামবাড়ি। সেই বাড়িতে বসে অনেকক্ষণ ধরে তামাক খেয়েছে। টোপরের বাইগন টমাটু একহাতে আঁকড়ে ধরা বুকের কাছে, অন্যহাতে নারকেলের ছোট্ট হুঁকা। গুরগুর গুরগুর করে যখন তামাক টানছে, হাজাম বাড়ির মুরব্বি সংসার আলী হাজামের সাইজ্জা মেয়ে (সেজোমেয়ে) তছি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা টোপরটা দেখে ফেলল। তছি জন্মপাগল। মাথার ঠিক নাই, কথাবার্তার ঠিক নাই। যুবতী বয়স কিন্তু চালচলন শিশুর মতো। ফলে তছির নাম পড়েছে তছি পাগলনী।

ছনুবুড়ির টোপরের দিকে তাকিয়ে তছি পাগলনী বলল, ও মামানি, টুপরে কী তোমার?

সংসার আলী হাজামের ছেলেমেয়েরা ছনুবুড়িকে ডাকে বুজি, তছি পাগলনী ডাকে মামানি। এই ডাকটা শুনলে পিত্তি জ্বলে যায় বুড়ির। কোথায় বুজি কোথায় মামানি! আত্মীয় অনাত্মীয় যে কাউকে বুজি ডাকা যায়, মামানি ডাকা যায় না। মামানি ডাক শুনলেই মনে হয় হাজামরা বুড়ির আত্মীয়। হাজামরা ছোটজাত। তারা কেমন করে ছনুবুড়ির আত্মীয় হয়! গ্রামের লোকে শুনলে বলবে কী! ছনুবুড়ির শ্বশুরপক্ষকে হাজাম ভাববে না তো! আজকালকার লোকেও মানুষের অতীত নিয়ে কম ঘটায় না। যা না তাই খুঁচিয়ে বের করা স্বভাবের মানুষের কী আকাল আছে গ্রামে!

এসব ভেবে রেগে গেল বুড়ি। তছি যে জন্মপাগল ভুলে গেল। হুঁকা নামিয়ে ছ্যানছ্যান করে উঠল। ঐ ছেমড়ি, তুই আমারে মামানি কচ ক্যা লো? আমি তর কেমুন মামানি।

ছনুবুড়ির সামনে, মাটিতে শিশুর মতো ল্যাছড় প্যাছড় করে বসল তছি। মাথা ভর্তি উকুন, সারাক্ষণ মাথা চুলকাচ্ছে। এখনও চুলকাল। চুলকাতে চুলকাতে বলল, কেমুন মামানি কইতে পারি না। টুপরে কী কও? কই থিকা চুরি করলা?

একে মামানি ডাক তার উপর চুরির বদলাম (বদনাম), মাথা খারাপ হয়ে গেল বুড়ির। হাতের লাঠি নিয়ে তড়বড় করে উঠে দাঁড়াল। গলা তিন চারগুণ চড়িয়ে ফেলল। আমি চোর? আমি চুরি করি, আ! হাজামজাতের মুখে এতবড় কথা?

ছনুবুড়ির রাগ চিৎকার একদম পাত্তা দিল না তছি। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে নির্বিকার গলায় বলল, তুমি তো চোর। ঐ মেন্দাবাড়ির ঝাকা থিকা হেদিনও তো তোমারে কহি (চিচিঙ্গা, এক ধরনের সবজি) চুরি করতে দেখলাম। আইজ কী চুরি করছো? দেহি টুপরে কী?

এবার চুরির কথা পাত্তা দিল না বুড়ি, মামানি নিয়ে পড়ল। ইচ্ছা কইরা মামানি কও আমারে! আত্মীয় বানাইছো, হাজাম বানাইছো আমারে! ওই মাগি, আমি কি হাজামজাতের বউঝি যে আমারে তুই মামানি কচ!

তছির বড়ভাই গোবেচারা ধরনের আবদুল তার বউ আর তছির মা তিনজনেই তখন বুড়িকে থামাবার চেষ্টা করছে। অর কথায় চেইতেন না বুজি। ও তো পাগল, কী থুইয়া কী কয়!

কীয়ের পাগল, কীয়ের পাগল ও? ভ্যাক ধরছে। অরে আমি দেখছি না তারিক্কার লগে ইরফাইন্নার ছাড়ায় ঢুকতে। পাগল অইলে এই হগল বোজেনি?

এ কথায় তছির মা ভাই স্তব্ধ হয়ে গেল। ভাইর বউ মুচকি হেসে মাথায় ঘোমটা দিল তারপর পশ্চিমের ছাপড়ায় গিয়ে ঢুকল।

তছি ততক্ষণে বুঝে গেছে তার নামে বদকথা বলছে ছনুবুড়ি। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পাগল বলে কথার পিঠে কথা বলতে শিখেনি সে, এক কথা শুনে অন্য কথা বলে। এখনও তাই করল। বিলাইয়ের (বিড়ালের মতন মুখ খিঁচিয়ে বলল, ঐ বুড়ি কূটনি, চুন্নিবুড়ি, মামানি ডাকলে শইল জ্বলে, না? হাজামরা মানুষ না! ছোডজাত? তয় এই ছোডজাতের বাইত্তে আহো ক্যা? তাগো বাইত্তে তামুক খাওনের সমায় মনে থাকে না তারা হাজাম! হাজামরা যেই উক্কায় তামুক খায় হেই উক্কায় মুখ দেও কেমতে? হাজামগো থালে বইয়া দেহি কতদিন ভাত খাইয়া গেছে! বাইর অও আমগো বাইত থন, বাইর অও। আর কুনোদিন যদি এই বাইত্তে তোমারে দেহি, টেংরি ভাইঙ্গা হালামু।

তছির মারমুখা ভঙ্গি দেখে ছনুবুড়ি থেমে গেছে। মুখে কথা আটকে গেছে তার। গো গো করতে করতে হাজামবাড়ি থেকে নেমেছে। দক্ষিণের চক ভেঙে হাঁটতে শুরু করছে। এখন শেষ বিকাল। এসময় বাড়ি ফিরা উচিত। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনালে হাঁটা চালায় অসুবিধা। ছানিপড়া চোখে এমনিতেই ঝাপসা লাগে দুনিয়া। তার উপর যদি হয় আন্ধার, পথ চলতে আছাড় উষ্ঠা খাবে ছনুবুড়ি। এই বয়সে আতুড় লুলা হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ নাই। ঘরে বসে জীবন কাটাবার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।

এসব ভেবে দ্রুত পা চালাচ্ছে বুড়ি, মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণে এসেছে, বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যে লম্বা টোসখোলা ঝোপ সেই ঝোপের এই পাশ থেকে হেলেপড়া খাজুর গাছটার পায়ের কাছে ছানিপড়া চোখে একটা লোককে বসে থাকতে দেখল। দেখে থমকে দাঁড়াল। গলা টানা দিয়ে কলল, কেডারে খাজুরতলায়?

খাজুরতলা থেকে সাড়া এল। আমি।

আমি কে?

মানুষটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাসি মুখে আমোদর গলায় বলল, কও তো কেডা?

বয়সী মাথা কাঁপাল ছনুবুড়ি। গলাডা চিনা চিনা লাগে!

তারপরই উচ্ছল হল। চিনছি। দউবরা। ঐ দউবরা খাজুরতলায় কী করচ তুই? গাছ ঝুড়ছ?

না অহনও ঝুড়ি না। যন্ত্রপাতি লইয়া বাইর অইছি। আইজ ঘুইরা ঘাইরা গাছ দেকতাছি। কাইল পশশু ঝুড়ম। তুমি আইলা কই থিকা?

জাহিদ খাঁর বাইত্তে দাওত খাইতে গেছিলাম।

কেডা দাওত দিলো তোমারে?

জাহিদ খাঁর বড়পোলায়। পোলার বউডা এত ভাল, দুই একদিন পর পরঐ দাওত দিয়া খাওয়ায় আমারে। কয় আমারে বলে অর মার মতন লাগে।

ছনুবুড়ির কথা শুনে হাসল দবির। কী খাওয়াইল?

ভাত আর চাইর পাঁচপদের মাছ। ইলসা, টাটকিনি, গজার। বাইং মাছও আছিলো। আমি খাই নাই। শ্যাষমেষ দিল দুদ আর খাজুরা মিডাই (খেজুরে গুড়)।

অহন খাজুরা মিডাই পাইলো কই?

আরবছরের মুড়ির জেরে (টিনে) রাইক্কা দিছিলো।

তারপর দবিরকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, বউডা এত ভাল বুজলি দউবরা, গাছের বাইগন, বিলাতি বাইগন (টমেটো) অহনও ডাঙ্গর হয় নাই, হেইডিও কতডি ছিড়া আমার টুপরে দিয়া দিল। কইলো বাইত্তে লইয়া যান। হাজামবাড়ি গেছি তামুক খাইতে, আমার টুপুর দেইক্কা তছি পাগলনী কয় কি, কী চুরি করলা! ক আমি বলে চোর!

ছনুবুড়ির স্বভাব জানার পরও তছির উপর রাগল দবির। বলল, বাদ দেও পাগল ছাগলের কথা। অর কথায় কী যায় আহে!

ছনুবুড়ি খুশি হয়ে বলল, হ, অর কথায় কী যায় আহে। তুই একখান কাম করিচ বাজান, পয়লা দিনের রস আমারে ইট্টু খাওয়াইচ।

খাওয়ামুনে। দুই চাইরদিন দেরি অইবো।

ক্যা, দেরি অইবো ক্যা?

গাছ ঝুইড়া ঠিল্লা পাততে সময় লাগবো না! উততইরা বাতাসটা আইজ খালি ছাড়ছে। আইজ থিকা রস আইছে গাছে। বেবাক কিছু ভাও করতে দুই তিনদিন লাগবো। পয়লা দিনের রস খাওয়ামুনে তোমারে, চিন্তা কইরো না। অহন খালি দেহ উততইরা বাতাসটা কেমনে ছাড়ছে! এইবারের রস দেখবা কেমুন মিডা অয়!

বিকাল শেষের উত্তরের হাওয়ায় ছনুবুড়ির পাটের আঁশের মতো চুল তখন ফুর ফুর করে উড়ছে। এই হাওয়ায় মনে কোনও পাপ থাকে না মানুষের, কূটনামী থাকে না কিন্তু ছনুবুড়ির মনে সামান্য কূটবুদ্ধি খেলা করতে লাগল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top