ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ শহরটি ইতিহাসে বিখ্যাত দুটি কারণে৷ মহাভারতে বলা আছে পঞ্চপাণ্ডব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাচীন এ নগর। তবে মহাভারতের উপাখ্যান পেরিয়ে পানিপথ বিখ্যাত হয়ে আছে আরো একটি কারণে৷ এই পানিপথের উন্মুক্ত প্রান্তরেই ইতিহাসের সাড়া জাগানো তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৫২৬ সালে বাবুরের বিরুদ্ধে দিল্লি সালতানাতের সুলতান ইব্রাহিম লোদী যুদ্ধে নামেন৷ ভারতের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী এ যুদ্ধের পর পানিপথ সাক্ষী হয়েছে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের৷ ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবর আর হেমচন্দ্র হিমু নেমেছিলেন এই পানিপথে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের শিরোনামে। ১৭৬১ সালে মারাঠাদের বিরুদ্ধে আহমদ শাহ আব্দালীর লড়াই ছিল ইতিহাসের শেষ পানিপথের যুদ্ধ। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতাপ যখন জায়গা করে নিয়েছে হারানো গৌরবের খাতায় তখন ভারতবর্ষে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যুদ্ধবাজ মারাঠা জাতি। মুঘল শক্তির সূর্য যখন নিভুনিভু তখন এই বিশৃঙ্খলার সুযোগে ভারতে থাকা দেশীয় ও বিদেশী মুসলিম সভাসদরা জড়িয়ে পড়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে। চতুর মারাঠারা এই দ্বন্দ্বে দেশীয় মুসলিমদের সাথে হাত মেলালে বিদেশীরা আফগানিস্তান থেকে ডেকে আনে আহমদ শাহ আবদালীকে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের এই মরণখেলায় মারাঠা নেতা সাদাশিভরাও ভাও এবং আফগান অধিপতি আহমদ শাহ আবদালী ১৭৬১ সালে জড়িয়ে পড়েন পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে।
সম্রাট আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর কার্যত মুঘল শক্তির ক্ষয় হতে থাকে। ১৭৩৯ সালে পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে ব্যাপক লুটপাট চালান। ছিনিয়ে নিয়ে যান ঐতিহাসিক ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনূর হীরা। নাদির শাহ লুটপাট চালিয়ে নিজ দেশে ফিরে গেলে ভারতবর্ষ পড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায়। মুঘলরা নিজেদের সাম্রাজ্য হারাতে থাকে। দিকে দিকে বিদ্রোহীদের হাতে চলে যায় মুঘল অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চল। মুঘলদের এই দৈন্যদশার সুযোগে উত্থান হয় মহারাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ মারাঠা জাতির। রাজনৈতিকভাবে সফল হতে তোড়জোড় শুরু করে মারাঠারা। দিল্লি নিজেদের অধীনে আনার এক সুদূরপ্রসারী উচ্চাভিলাষী নীতি বাস্তবায়নের জন্য মারাঠারা এবার হাত মেলায় দেশীয় মুসলিম সভাসদদের সাথে। সেসময় ভারতের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে বিরোধ চলছিল দেশীয় মুসলিম সভাসদ এবং বিদেশী মুসলিম সভাসদদের মাঝে। দেশীয়রা মারাঠাদের উপর নির্ভর করলে বিদেশীরা হাত মেলায় আফগান অধিপতি আহমদ শাহ আবদালীর সাথে। মারাঠাদের নেতা তখন রঘুনাথ রাও। ১৭৫২ সালে যখন আবদালী পূর্ণ রণসাজে ভারত আসেন তখন তাকে মোকাবেলা করতে হয় বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধ। ভারতে প্রবেশ করেই আহমদ শাহ আবদালী কাশ্মীর, মূলতান ও পাঞ্জাব দখল করে নেন। পাশাপাশি হিন্দুস্তানে ধীরে ধীরে মিত্র খুঁজতে থাকেন তিনি। আবদালী যখন শক্তি বৃদ্ধি করছেন তখন মারাঠারাও বসে নেই। ইতিমধ্যে মুঘলদের কাছ থেকে দাক্ষিণাত্য দখল করে বেশ শক্তিশালীই হয়ে উঠেছিল মহারাষ্ট্রের এই যুদ্ধংদেহী জাতিগোষ্ঠী। ইতিমধ্যে মারাঠা আর আহমদ শাহ আবদালীর মধ্যে ছোট ছোট খণ্ডযুদ্ধ হতে থাকে। খণ্ডযুদ্ধের এই সময়টাতে ভারতবর্ষের রাজনীতিতেও আসে পরিবর্তন। ১৭৫৯ সালে সরদার দত্তজি সিন্ধিয়া বনে যান মারাঠাদের নতুন অধিপতি। আবদালীর কাছে সিন্ধিয়া বাহিনীর পরাজয় ঘটলে মারাঠাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সাদাশিভরাও ভাও। উগ্র জাতীয়তাবাদী সাদাশিভরাও এবার সরাসরি জড়িয়ে পড়লেন আবদালীর সাথে যুদ্ধে। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে অস্ত্র শাণ দিতে থাকে দুই বাহিনী।
ময়দানে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধঃ মুখোমুখি মারাঠা-আফগান শক্তি
মারাঠাদের শক্তিমত্তা বেশ মজবুত হওয়া সত্ত্বেও সাদাশিভারাও আফগানদের শক্ত প্রতিপক্ষ বিচার করে সিন্ধিয়া, বুন্দেল, হলকার, জাত, ইব্রাহিম খান গার্দির গোলন্দাজ বাহিনী এবং গাইখন্দের যোদ্ধাদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। ফলে মারাঠারা এক বিশাল সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। ভাও ফরাসিদের নিকট থেকে গোলাবারুদ ক্রয় করে তার সামরিক খাতকে আরো শক্তিশালী করেন।ওদিকে রোহিলার নজিব-উদ-দৌলা এবং অযোদ্ধার নবাব সুজা-উদ-দৌলা আফগানদের সাথে যুদ্ধে যোগদান করে। ফলে আফগানরাও অনেক শক্তিশালী ফৌজ গঠন করতে সক্ষম হয়। ১৭৬১ সালের ১৪ জানুয়ারি দুই পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে নেমে পড়ে। প্রথমেই মারাঠারা আফগানদের মিত্র রোহিলার সৈন্যদের উপর চড়াও হয় এবং প্রায় বিপর্যস্ত করে ফেলে। ওদিকে আবদালীর আফগান সৈন্যরা সতর্ক অবস্থায় যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এবং নিজেদের আক্রমণ শাণাতে থাকে। ভারতবর্ষের যুদ্ধবাজ মারাঠারা নিজেদের সকল শক্তিমত্তা ব্যবহার করে, জমে উঠে সেয়ানে সেয়ানে যুদ্ধ। মারা পড়তে থাকে দু পক্ষের অনেক সৈন্য। পানিপথ আবার সাক্ষী হয় প্রাণসংহারী আরেক যুদ্ধে। সহসাই মারাঠা সেনাপতি হলকার রাও যুদ্ধক্ষেত্রে হতে পলায়ন করলে পরিস্থিতির মোড় পাল্টাতে থাকে। তবে মারাঠাদের আরেক মিত্র ইব্রাহিম গর্দি আফগানদের রুখে দিয়ে যুদ্ধ জিইয়ে রাখেন। ওদিকে আবদালীর গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে মারাঠাদের মধ্যে কিছুটা বিশৃংখলা দেখা দিলেও তারা একেবারে দমে যায়নি। সহসাই সাদাশিভারাও যেন কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেন। আর এই সুযোগে আহমদ শাহ আবদালী মারাঠাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। মরতে মরতে অবশেষে ক্লান্ত মারাঠারা চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে। আর এরই সাথে প্রায় অপারেজয় মারাঠারা সাময়িক সময়ের জন্য ভারতের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে। যুদ্ধের পর আফগানদের হাতে প্রচুর সাধারণ মারাঠা জনগণ মারা পড়ে। তবে এই যুদ্ধ ইতিহাসে তেমনভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি৷ কারণ আহমদ শাহ আবদালীকে দিল্লি শাসন না করেই আফগানিস্তান ফিরে যেতে হয়েছিল। ফলে খুব দ্রুতই মারাঠারা আবার ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয়।