১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে জেরুজালেমের এক বাজারে ফিলিস্তিনিদের বোমা হামলায় ১৬ ইসরায়েলি নিহত এবং ১৭০ জন আহত হয়। এই ঘটনার পর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস দায় স্বীকার করে। এটিই ছিল হামাসের প্রথম হামলা। তখন ইসরায়েলের ক্ষমতায় ছিলেন নেতানিয়াহু। এর প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলের তুরুপের তাস মোসাদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে আরো কয়েক দফা হামলার পর মোসাদ নড়েচড়ে বসে। হামাসের তখনকার প্রভাবশালী নেতা ছিলেন খালেদ মেশাল। নেতানিয়াহু মেশালকে হত্যা করতে দায়িত্ব দিলেন মোসাদের গুপ্তহত্যার কাজে জড়িত বিশেষ সেল কে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে অন্য জায়গায়। খালেদ মেশাল তখন অবস্থান করছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ জর্ডানে। সেসময় ইসরায়েলের সাথে জর্ডানের শান্তিচুক্তি থাকার কারণে মোসাদের জন্য এই অপারেশন কিছুটা জটিল হয়ে যায়।
কে এই খালেদ মেশাল?
১৯৫৬ সালের ২৮ মে পশ্চিম তীরের সিলওয়াদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খালেদ মেশাল। তার জীবনের প্রথম ১১ বছর পরিবারের সাথে পশ্চিম তীরেই কাটান। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করে নিলে মেশালের পরিবার পাড়ি জমায় কুয়েতে। মেশালের বাবা সেখানে একটা মসজিদে ইমামের চাকরি নেন। কুয়েতেই মেশালের রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয়। যোগ দেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্যালেস্টানিয়ান ব্রাঞ্চে৷ ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এক্টিভিজমে সক্রিয় থাকা মেশাল ১৯৭৪ সালে কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হোন। এই বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়েই খালেদ মেশাল প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনে গভীরভাবে যুক্ত হোন। পদার্থের পাঠ শেষ করে গ্রাজুয়েট মেশাল ১৯৮৪ সালে শিক্ষকতা পেশা বাদ দিয়ে প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মীতে পরিণত হন। ১৯৮৭ সালের প্রথম ইন্তিফাদার পর প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনের এক্টিভিস্টরা প্রথমবারের মত হামাস নাম নিয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। উপসাগরীয় যুদ্ধে অবস্থার প্রতিকূলতায় কুয়েত থেকে জর্ডানে চলে যান খালেদ। আর সেখানেই ১৯৯২ সালে ঘোষিত হামাসের পলিটিকাল ব্যুরোর মেম্বার হন তিনি। ১৯৯৬ সালে মেশাল এই ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হোন।
খালেদ মেশাল হত্যাচেষ্টাঃ ব্যর্থ মোসাদ
খালেদ মেশাল হত্যা চেষ্টা এবং ব্যর্থ হওয়া মোসাদের ইতিহাসে এক কলংকজনক ঘটনা। দুনিয়ার সবচেতে সুপ্রশিক্ষিত এবং ভয়ংকর এই গুপ্তচরের দল নিজেদের কাংখিত শিকারকে দক্ষতার সাথে আক্রমণ করতে কখনোই ভুল করেনা। কিন্তু নাটকীয়ভাবে এই ঘটনার ব্যর্থতা মোসাদ এবং ইসরায়েলের গোমর ফাঁস করে দেয়। নেতানিয়াহু যখন মেশালকে হত্যার নির্দেশ দিলেন তখন এক প্রতিকূল পরিবেশে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে মোসাদের ছয়জন চর কানাডার ভুয়া পাসপোর্টে অবৈধভাবে টুরিস্ট সেজে জর্ডানে প্রবেশ করে। পরিবেশ প্রতিকূল ছিল এজন্য যে তখন জর্ডান ও ইসরায়েল উভয়েই কেউ কারো সার্বভৌমত্ব লংঘন করবে না মর্মে চুক্তিবদ্ধ ছিল। নেতানিয়াহু প্রথমে জর্ডানে এমন অপারেশন না চালানোর আদেশ দিলেও মেশালকে হত্যা করতে মোসাদের অন্য কোন বিকল্প ছিল না।এই অপারেশনে অংশ নেয়া মোসাদ চর মিশকা বিন ডেভিড বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে তারা যখন জর্ডানে প্রবেশ করেন তখন তার কিছুটা ভয় লাগছিল। মিশকা উল্লেখ করেন, তখনো পর্যন্ত গুপ্তহত্যার তেমন কোন রেকর্ড ছিল না মোসাদের। তিনি নিজে ইতিপূর্বে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করায় হাই ভোল্টেজ এই কিলিং মিশনে কিছুটা নার্ভাস বোধ করছিলেন। খালেদ মেশাল তখন অবস্থান করছিলেন জর্ডানের আম্মানে। তিনি জানতেন তার প্রতি গুপ্তচরদের নজর আছে। তাই পারতপক্ষে তিনি সাধারণের সামনে আসতেন না। ইতিমধ্যে ৬ দিনের ভিসা নিয়ে আসা মোসাদ এজেন্টরা টানা ৫ দিন মেশালকে বাগে পেতে ব্যর্থ হয়। ষষ্ঠ দিন মোসাদের দুই এজেন্ট সুবিধামত অবস্থানে মেশালকে নিকটে পায়। তাদের হাতে ছিল বিষাক্ত রাসায়নিক। উদ্দেশ্য ছিল মেশালের গলায় ছিটিয়ে দেয়া যাতে করে শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তিনি মারা যান। আর এই রাসায়নিকের প্রতিষেধক ছিল সেই মিশকা বিন ডেভিডের কাছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেশালের গলা বরাবর ঐ বিষ ছুড়ে দেয় দুই চর৷ কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মেশাল তখন তার মেয়ের ডাকে পেছন ফিরে তাকালে ঐ বিষ মেশালের কানে পড়ে যায়। নিজেদের কার্য সমাধা করে তৎক্ষনাৎ দৌড়ে আগে থেকে প্রস্তুত রাখা গাড়িতে উঠে পড়ে দুই চর। কিন্তু আবু সাইফ নামের আরেক হামাস নেতা ওদের দেখে ফেলেন। তিনি ঐ গাড়ির পিছু নেন এবং গাড়ির নাম্বার ঠুকে ফেলেন। আবু সাইফ থেকে বাঁচতে মোসাদের দুই চর গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়াতে থাকে। ইতিমধ্যে সাইফ চিৎকার করে বলতে থাকেন, "এরা খালেদ মেশালকে হত্যা করেছে, এরা মোসাদের চর"। আবু সাইফ অবশেষে এদের ধরতে সমর্থ হোন এবং সাইফের সাথে ধস্তাধস্তিতে আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে যায়৷ জর্ডান পুলিশ এই দুই চরকে আটক করে নিশ্চিত হয় যে এরা কানাডার নাগরিক নয়। মুহূর্তের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ইসরায়েলের জোর কূটনৈতিক তৎপরতা। মোসাদ প্রধান ড্যানি ইয়াটম উড়ে যান জর্ডানে । কিন্তু ততক্ষণে জর্ডানের বাদশাহ হুসেনের মেজাজ তুংগে। মিশকা বলেছিলেন, বাদশাহ হুসেন তখন খুব ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং অতিদ্রুত মেশালকে সুস্থ করতে নেতানিয়াহুর কাছে এর প্রতিষেধক চাচ্ছিলেন। ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ প্রথমে টালবাহানা করলেও শেষ পর্যন্ত বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে প্রতিষেধক দিতে রাজি হয়। মিশকা বিন ডেভিড বলেছিলেন, তিনি যখন প্রতিষেধক নিয়ে জর্ডানের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানের কাছে যান তখন তার চোখেমুখে ছিল ঘৃণার ছাপ। দুইদিন পর কোমা থেকে সুস্থ হয়ে ফেরেন মেশাল। জানা যায় তার উপর ছুঁড়া রাসায়নিকটি ছিল ফ্যান্টানিল। এই ঘটনার অব্যবহিত পর ইসরায়েল ভাবমূর্তি সংকট চরমে পৌঁছে। মোসাদ প্রধান ড্যানি ইয়াটম নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ান। গ্রেফতারকৃত মোসাদ এজেন্টদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের জন্য ত্রাস হামাস নেতা আহমদ ইয়াসিনকে মুক্তি দিতে হয়। সাথে করে ৬১ জন জর্ডান ও ফিলিস্তিনি বন্দীদেরও মুক্ত করে ইসরায়েল। পুরো ঘটনায় জর্ডানের বাদশাহ হুসেনের ভূমিকা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার অনড় অবস্থানে ইসরায়েল নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৮ সালে বের হওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে নেতানিয়াহুকে দোষী সাব্যস্ত না করলেও ড্যানি ইয়াটমকে দায়ী করা হয়। মেশাল হত্যাচেষ্টার ব্যর্থতা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়। মিশকা বিন ডেভিড বলেছিলেন, মানুষ পারিবারিক অনুষ্ঠানেও চরদের ব্যর্থতা নিয়ে গালমন্দ করত।