বল্টুর দুরন্তপনায় অস্থির পাড়া প্রতিবেশী, সহপাঠীরা। এমনকি পাঠশালার শিক্ষকেরাও তিক্ত। ঘরে বাইরে দস্যিপনা সমানে সমান। কিশোর বয়স কোন বাধা মানে না, মানে না বিধি-নিষেধ। এক উদ্দাম স্রোতধারা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় বল্টুকে এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনায়। এদিক থেকে ওদিক। বল্টুর এই হেন কাজে মায়ের কাছে বিচার আসতেই থাকে, এই ছেলেকে বুঝিয়ে কোন লাভ হয় না, কত লাঠি ভাঙা পড়েছে তার হিসেব নেই।
একদিনের ঘটনা মা তাকে বুঝাচ্ছে এত দুষ্টামি করলে চলে! একটু ভালো হয়ে চল। বল্টু হি হি হি করে হেসে বলে মা আমি তো তোমার লক্ষ্মী ছেলে। এমন সময় কমলার মা চিৎকার করতে করতে আসে। ঠিক অই সময় বল্টু খাটের নিচে গিয়ে ঢুকে।
দেখ গো দেখ তোমার ছেলে আমার মেয়ের মাথা ফাটিয়ে কী করেছে, যে মেয়েকে আমি কোন দিন চড় থাপ্পড় দেই না, বক বক করতে করতে চলে গেল কমলার মা।
বল্টুর মা আর চোখে পানি ধরে রাখতে পারল না, কেঁদে ফেললো। দুপুর গড়িয়ে রাত হল, এমন সময় বল্টুর বোন আসল, 'আমার পরীক্ষা তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ! বল্টু কোথায়?'
আর বলিস না সেই দুপুর থেকে কই যে গেল আর এলো না।
আচ্ছা আমি দেখছি এই বলে বল্টুর রুমের দিকে ছুটল, খাটের নিচে তাকাতেই দেখল নিচে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।
এই বল্টু উঠ উঠ, মা মা দেখে যাও তোমার ছেলে খাটের নিচে ঘুমাচ্ছে, উহ গায়ে কী জ্বর।
মা এসে বলল, আর ঢং করতে হবে না, তাড়াতাড়ি উঠ, মা এবার দেখল সত্যি সত্যি জ্বর, তারপর খাটের নিচ থেকে বের করে এনে খাটে শুইয়ে দিল।
পরের দিন সকাল হতে না হতেই আবার ছুটল গুলতি নিয়ে, কবে যে আবার পাখি ধরার নেশা পেয়েছে। মা পেছন থেকে কত ডাকল কোনো সাড়া নেই।
তারপর যখন বিকেল হলো ঐ পাড়ার মোড়লের ছেলে এসে বলল, তোমার ছেলে আমাদের বাগানের নতুন গাছের আম পেড়ে ফেলেছে, তোমার ছেলেকে যদি শায়েস্তা না কর তাহলে কিন্তু বড় বিপদ হবে!!! এই বলে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে বল্টু এলো, 'মা ভাত দাও বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে'।
মা দেখল ছেলের হাতে একটা খাঁচা, তার মধ্যে ময়না পাখি। বল্টু বলল, দেখ না মা কী সুন্দর পাখি, ঐ তো মোড়লের আমগাছ থেকে ধরেছি। কথা শেষ না হতেই মা থাপ্পড় মেরে বলল, তুই নাকি ওদের বাগান থেকে আম পেড়েছিস? কে বলেছে অই মোড়লের ছেলে বিচার দিয়েছে তাই না? আরে ছোট একটা গাছ তাই গুলতির জন্য কয়েকটি মাত্র পেড়েছি তাতেই বিচার। আমার কী করার? পড়ে গেছে, আচ্ছা তাড়াতাড়ি ভাত দাও।
মা বলল, আচ্ছা তুই ভালো হয়ে চলতে পারিস না, সবসময় ছেলেদের দেখি কত সুন্দর, সবাই ভালো হয়ে চলে। আর তুই, এই যে পাখিটা ধরলি ওর তো মা-বাবা আছে ওরা তো কষ্ট পায়, তোকে মনে মনে বদ দোয়া দিচ্ছে।
পরদিন সকালে মা দেখল খাঁচাটা নেই, কিরে বল্টু তোর পাখি কোথায়?
মা তুমি তো বলেছ পাখি কষ্ট পায়, তাই ছেড়ে দিয়েছি।
মা মনে মনে খুশি হলো।
বল্টু এখন মেট্রিক পাস করেছে, সবেমাত্র ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। তার চোখে রঙিন স্বপ্ন, মাকে নিয়ে অনেক ভাবনা। মাকে প্রতি মাসে ১টি করে শাড়ি কিনে দেব ঈদ এলে। পাশের বাসার পিন্টুর মাকেও দিব।
পিন্টু তো বেঁচে নেই!!!!
আহা! কী ফক ফকে সাদা রঙের ছিল ছেলেটা আমি খুব হিংসা করতাম। একদিন খুব মার মেরে ছিলাম পরে বলেছিলাম যদি তোর মাকে বলিস তবে কঞ্চি বাড়ি খেলায় নিব না। গোল্লাছুটেও।
পিন্টু বলল আচ্ছা।
নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়ছিল আমি খোশকা গাছের পাতা দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম। পরে কয়েকদিন পিন্টু না আসায় আমার গা ভয়ে গরম হয়ে গিয়েছিল যদি ওর মা জেনে যায়। পিন্টু যদি বলে দেয়। এমন করে এক মাস ২ মাস কেটে গেল।
একদিন স্কুল থেকে ফিরতে ছিলাম পিন্টুর নানিকে দেখলাম। কৌতূহল মনে এগিয়ে গেলাম পিন্টু নাকি ক্যানসার হয়েছিল মারা গিয়েছে।
পিন্টুর মৃত্যুর পর মা কেন জানি আমাকে আর বকেনি।
ভাবতে ভাবতে আঁতকে উঠল, চোখের পানি মুছে শুনার চেষ্টা করল কিসের শব্দ।
জানতে পারল পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষকে নস্যাৎ করার জন্য আসা বাংলাদেশের বড় বড় শহর এবং গ্রাম-গঞ্জে আক্রমণ করেছে দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, এর পরের দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ।
সে ভেবে চিন্তে স্থির করল দেশের জন্য কিছু করতে হবে, মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে হবে।
কিন্তু মাকে বলে যাওয়া যাবে না। সে মাকে চিঠি লেখল,
প্রিয় মা,
তোমার কাছে আমি অনেক শান্তি নিয়ে ফিরে আসব। এই দেশটাকে স্বাধীন করব, দেখ তোমার মুখে হাসি ফুটবে আমার জন্য দোয়া কর।
ইতি তোমার বল্টু।
আজ ২০১৮ সাল প্রায় ৪৬ বছর পেরিয়েছে। ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ সারা দেশে শোক পালন হয় তবুও বিজয়ের উল্লাস। কিন্তু মা এখনো ছেলে ফিরে আসার জন্য পথ গুনছে।
আর মায়ের নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে বল্টুর চিঠির দিকে, তখন মায়ের চোখ থেকে পড়ল একফোঁটা পানি।
লেখিকা -নাফিসা রায়হানা মুবাশ্বির
একদিনের ঘটনা মা তাকে বুঝাচ্ছে এত দুষ্টামি করলে চলে! একটু ভালো হয়ে চল। বল্টু হি হি হি করে হেসে বলে মা আমি তো তোমার লক্ষ্মী ছেলে। এমন সময় কমলার মা চিৎকার করতে করতে আসে। ঠিক অই সময় বল্টু খাটের নিচে গিয়ে ঢুকে।
দেখ গো দেখ তোমার ছেলে আমার মেয়ের মাথা ফাটিয়ে কী করেছে, যে মেয়েকে আমি কোন দিন চড় থাপ্পড় দেই না, বক বক করতে করতে চলে গেল কমলার মা।
বল্টুর মা আর চোখে পানি ধরে রাখতে পারল না, কেঁদে ফেললো। দুপুর গড়িয়ে রাত হল, এমন সময় বল্টুর বোন আসল, 'আমার পরীক্ষা তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ! বল্টু কোথায়?'
আর বলিস না সেই দুপুর থেকে কই যে গেল আর এলো না।
আচ্ছা আমি দেখছি এই বলে বল্টুর রুমের দিকে ছুটল, খাটের নিচে তাকাতেই দেখল নিচে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।
এই বল্টু উঠ উঠ, মা মা দেখে যাও তোমার ছেলে খাটের নিচে ঘুমাচ্ছে, উহ গায়ে কী জ্বর।
মা এসে বলল, আর ঢং করতে হবে না, তাড়াতাড়ি উঠ, মা এবার দেখল সত্যি সত্যি জ্বর, তারপর খাটের নিচ থেকে বের করে এনে খাটে শুইয়ে দিল।
পরের দিন সকাল হতে না হতেই আবার ছুটল গুলতি নিয়ে, কবে যে আবার পাখি ধরার নেশা পেয়েছে। মা পেছন থেকে কত ডাকল কোনো সাড়া নেই।
তারপর যখন বিকেল হলো ঐ পাড়ার মোড়লের ছেলে এসে বলল, তোমার ছেলে আমাদের বাগানের নতুন গাছের আম পেড়ে ফেলেছে, তোমার ছেলেকে যদি শায়েস্তা না কর তাহলে কিন্তু বড় বিপদ হবে!!! এই বলে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে বল্টু এলো, 'মা ভাত দাও বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে'।
মা দেখল ছেলের হাতে একটা খাঁচা, তার মধ্যে ময়না পাখি। বল্টু বলল, দেখ না মা কী সুন্দর পাখি, ঐ তো মোড়লের আমগাছ থেকে ধরেছি। কথা শেষ না হতেই মা থাপ্পড় মেরে বলল, তুই নাকি ওদের বাগান থেকে আম পেড়েছিস? কে বলেছে অই মোড়লের ছেলে বিচার দিয়েছে তাই না? আরে ছোট একটা গাছ তাই গুলতির জন্য কয়েকটি মাত্র পেড়েছি তাতেই বিচার। আমার কী করার? পড়ে গেছে, আচ্ছা তাড়াতাড়ি ভাত দাও।
মা বলল, আচ্ছা তুই ভালো হয়ে চলতে পারিস না, সবসময় ছেলেদের দেখি কত সুন্দর, সবাই ভালো হয়ে চলে। আর তুই, এই যে পাখিটা ধরলি ওর তো মা-বাবা আছে ওরা তো কষ্ট পায়, তোকে মনে মনে বদ দোয়া দিচ্ছে।
পরদিন সকালে মা দেখল খাঁচাটা নেই, কিরে বল্টু তোর পাখি কোথায়?
মা তুমি তো বলেছ পাখি কষ্ট পায়, তাই ছেড়ে দিয়েছি।
মা মনে মনে খুশি হলো।
বল্টু এখন মেট্রিক পাস করেছে, সবেমাত্র ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। তার চোখে রঙিন স্বপ্ন, মাকে নিয়ে অনেক ভাবনা। মাকে প্রতি মাসে ১টি করে শাড়ি কিনে দেব ঈদ এলে। পাশের বাসার পিন্টুর মাকেও দিব।
পিন্টু তো বেঁচে নেই!!!!
আহা! কী ফক ফকে সাদা রঙের ছিল ছেলেটা আমি খুব হিংসা করতাম। একদিন খুব মার মেরে ছিলাম পরে বলেছিলাম যদি তোর মাকে বলিস তবে কঞ্চি বাড়ি খেলায় নিব না। গোল্লাছুটেও।
পিন্টু বলল আচ্ছা।
নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়ছিল আমি খোশকা গাছের পাতা দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম। পরে কয়েকদিন পিন্টু না আসায় আমার গা ভয়ে গরম হয়ে গিয়েছিল যদি ওর মা জেনে যায়। পিন্টু যদি বলে দেয়। এমন করে এক মাস ২ মাস কেটে গেল।
একদিন স্কুল থেকে ফিরতে ছিলাম পিন্টুর নানিকে দেখলাম। কৌতূহল মনে এগিয়ে গেলাম পিন্টু নাকি ক্যানসার হয়েছিল মারা গিয়েছে।
পিন্টুর মৃত্যুর পর মা কেন জানি আমাকে আর বকেনি।
ভাবতে ভাবতে আঁতকে উঠল, চোখের পানি মুছে শুনার চেষ্টা করল কিসের শব্দ।
জানতে পারল পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষকে নস্যাৎ করার জন্য আসা বাংলাদেশের বড় বড় শহর এবং গ্রাম-গঞ্জে আক্রমণ করেছে দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, এর পরের দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ।
সে ভেবে চিন্তে স্থির করল দেশের জন্য কিছু করতে হবে, মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে হবে।
কিন্তু মাকে বলে যাওয়া যাবে না। সে মাকে চিঠি লেখল,
প্রিয় মা,
তোমার কাছে আমি অনেক শান্তি নিয়ে ফিরে আসব। এই দেশটাকে স্বাধীন করব, দেখ তোমার মুখে হাসি ফুটবে আমার জন্য দোয়া কর।
ইতি তোমার বল্টু।
আজ ২০১৮ সাল প্রায় ৪৬ বছর পেরিয়েছে। ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ সারা দেশে শোক পালন হয় তবুও বিজয়ের উল্লাস। কিন্তু মা এখনো ছেলে ফিরে আসার জন্য পথ গুনছে।
আর মায়ের নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে বল্টুর চিঠির দিকে, তখন মায়ের চোখ থেকে পড়ল একফোঁটা পানি।
লেখিকা -নাফিসা রায়হানা মুবাশ্বির