গরম আর বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়ার প্রকোপ হঠাৎই বেড়েছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ডায়রিয়ার রোগীতে হাসপাতালগুলো পূর্ণ। রক্ষা পাচ্ছে না শিশুরাও। সময়মতো চিকিৎসা না করালে তীব্র আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা।
বুকের দুধ বন্ধ নয়
শিশুদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে বুকের দুধ নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করা গেলে শিশুদের ডায়রিয়া হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। ছয় মাসের আগে শিশুকে বাড়তি খাবার শুরু করে দেওয়া, এক বছরের আগে গরুর দুধ দেওয়া, কিংবা ছোট শিশুদের বাইরের কেনা খাবার, চিপস, জুস ইত্যাদি খাওয়ানো ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ। অনেক সময় মা-বাবা শিশুকে এগুলো না দিলেও আত্মীয়স্বজন নিয়ে আসেন। এসব অভ্যাস দূর করা গেলে শিশুরা ডায়রিয়ামুক্ত হতে পারবে। এর সঙ্গে মা-বাবা কিংবা শিশুকে যাঁরা দেখাশোনা করেন, তাঁদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাটা খুব জরুরি। শিশুকে খাওয়ানোর আগে, মলমূত্র পরিষ্কার করার পর বা খাবার প্রস্তুত করার আগে অবশ্যই ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। একটু বড় শিশুদের নিজে থেকে হাত ধোয়া শেখাতে হবে।
ডায়রিয়া হলে বুকের দুধ বন্ধ করে দেওয়া যাবে না, বরং বারবার দিতে হবে।
বড়দের চেয়ে শিশুদের শরীরের কোষের বাইরের পানি বা এক্সট্রা সেলুলার ফ্লুইড বেশি। ফলে ডায়রিয়া হলে সহজেই তাদের শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে। পানিশূন্যতা তীব্র হলে শিশু অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। কখনো কিডনি বিকল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাই পানিশূন্যতার লক্ষণ জানা থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
পানিশূন্যতার লক্ষণ
শিশুদের ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা মারাত্মক হতে পারে। এ সমস্যার লক্ষণগুলো বারবার খেয়াল করুন। যদি শিশুর অস্থিরতা ও তৃষ্ণা খুব বেশি মনে হয়, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, ত্বক শুষ্ক ও ঢিলে দেখায়, তবে বুঝতে হবে পানিশূন্যতা হচ্ছে। শিশু নিস্তেজ হয়ে গেলে বা তার প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে সেগুলো খারাপ লক্ষণ। যথেষ্ট খাওয়ার স্যালাইন দেওয়ার পরও এমন হতে পারে।
স্যালাইনই চিকিৎসা
ডায়রিয়া হলে শিশুকে বারবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। বয়স দুই বছরের নিচে হলে তাদের প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০ থেকে ২০ চামচ, দুই বছরের বেশি বয়সীদের প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ২০ থেকে ৪০ চামচ করে স্যালাইন দিন। বমি হয়ে গেলে ১০ মিনিট অপেক্ষার পর আবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
সব বয়সের জন্য স্যালাইন বানানোর নিয়ম কিন্তু একই, বয়স কম বলে আধা প্যাকেট বা কম পানিতে গুলিয়ে স্যালাইন বানানো যাবে না। অনেকেই মনে করেন, স্যালাইন বোধ হয় ডায়রিয়ার কোনো ওষুধ, তা কিন্তু নয়। ডায়রিয়ায় সাধারণত কোনো ওষুধ লাগে না, পানিশূন্যতা না হলেই হলো।
শিশুর ডায়রিয়া হলে মা স্যালাইন খেলে শিশুর কিন্তু কোনো লাভ হবে না। শিশুকেই খাওয়াতে হবে। ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে শিশুর ডায়রিয়া এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আর কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। তবে শিশুদের ডায়রিয়ায় তীব্র জ্বর থাকলে বা মলের সঙ্গে রক্ত গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে।
মায়ের খাবার নিয়ে ভাবনা
শিশুর ডায়রিয়ার সঙ্গে মায়ের খাবারের কোনো সম্পর্ক নেই, তাই মায়ের খাওয়াদাওয়ায় কোনো নিষেধ নেই। অনেকে মায়ের খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে চান, শাকসবজি, মাছ-মাংস নিষেধ করেন—এর কোনো দরকার নেই। মা পুষ্টিকর খাবার খাবেন।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ডাবের পানি, ভাতের মাড় ইত্যাদি দিতে পারেন। তবে বাজারের কোমল পানীয়, জুস, বেশি চিনিযুক্ত চা কিংবা কফি দেওয়া যাবে না। স্বাভাবিক সব খাবার খাওয়ানো যাবে। শিশুকে মায়ের দুধ অবশ্যই দিয়ে যেতে হবে। স্তন্যপানকারী শিশুর ডায়রিয়া হোক বা না হোক, তাকে মায়ের দুধের পরিবর্তে অন্য কোনো দুধ দেওয়া উচিত নয়।
কখন হাসপাতালে নেবেন
শিশু কিছুই খেতে না পারলে, অনবরত বমি করলে, নিস্তেজ হয়ে পড়লে, মলের সঙ্গে রক্ত গেলে কিংবা ডায়রিয়া ১৪ দিনের বেশি স্থায়ী হলে তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। ইদানীং করোনায় আক্রান্ত শিশুদেরও ডায়রিয়া হচ্ছে। তাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
* ডা. আবু সাঈদ | শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ