What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected জলকন্যা ( হুমায়ুন আহমেদ ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
আঙুল


দেখি হাত দেখি।

এক হাত মেললেই হয়–মোবারক দুহাত মেলে ধরল। মোবারকের কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে ডাক্তারকে হাত দেখাচ্ছে। বামুনদের মত বেঁটে যে ভদ্রলোক হাত দেখছেন–তিনি কোন ডাক্তার না। ফিল্মের ডাইরেক্টার। ফিল্মের নাম শেষ প্রতিশোধ।

মোবারক লক্ষ্য করল উত্তেজনায় তার হাতের আঙুল কাঁপছে। দশটা আঙুল কাঁপার কথা, তার কাঁপছে সাতটা। কারণ ডান হাতের পাঁচটা আঙুলের মধ্যে তিনটা তার নেই, লেদ মেশিনে কাটা পড়েছে। মেশিনে কাটা বলেই সুন্দর করে কাটা। দেখতে খুব খারাপ লাগে না।

ডাইরেক্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে কাটা আঙুল দেখছেন। তার পছন্দ হচ্ছে কিনা মোবারক বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোকের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বেঁটে লোক খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়।

আপনার নাম কি বললেন যেন?

স্যার, আমার নাম মোবারক।

আমরা আসলে চেয়েছিলাম চারটা আঙুল কেটেছে এমন লোক। এক হাতে শুধু একটাই আঙুলের অন্য এক ধরনের বিউটি আছে। যাই হোক, আপনাকে দিয়েও চলবে। অভিনয় করেছেন কখনো?

জ্বি না স্যার।

অভিনয় না করলেই ভাল। যা বলব ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তাই করবেন। পারবেন না?

জ্বি স্যার, পারব।

গুড। খুব সহজ দৃশ্য। এক অত্যাচারী লোক তোমাকে ধরেছে। সে ছড়তা দিয়ে কচ কচ করে তোমার হাতের তিনটা আঙুল কেটে ফেলবে। এক একবার কাটবে আর তুমি আঁ বলে এক চিৎকার দিবে।

মোবারকের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ডাইরেক্টার সাহেব একটু আগে তাকে আপনি করে বলছিলেন, এখন তুমি বলছেন। শুরু থেকে তুমি করে বললে অস্বস্তি লাগত না। প্রথম কিছুক্ষণ আপনি বলায় লাগছে। ছড়তা দিয়ে আঙুল কাটার ব্যাপারটাও সে বুঝতে পারছে না। আঙুল তো কাটাই আছে, আবার নতুন করে কাটবে কি?

তোমার বুকে লোম আছে?

মোবারক লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি না স্যার।

ডাইরেক্টার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, পুরুষের বুকে লোম আজকাল উঠেই গেছে। কারণটা বুঝলাম না। যাই হোক, তুমি শার্টটা খুলে ফেল। খালি গায়েই ভাল লাগবে। খোল, শার্ট খোল।

এত লোকের মাঝখানে শার্ট খুলতে মোবারকের লজ্জা লাগছে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন পুরুষ মানুষের উদোম হওয়ার দৃশ্য তারা আগে দেখেনি। এদের মধ্যে মেয়েছেলেও আছে। একটা মেয়ে তো একেবারে লাল টুকটুক, গদি দেয়া চেয়ারে বসে আছে। নায়িকা-টায়িকা হবে। নায়িকা না হলেও নায়িকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কিংবা ছোট বোন। মেয়েটা একটু পরপর বিশ্রী ভঙ্গিতে হাই তুলছে। তার মুখটা ছোট তবে হা করার সময় বিশাল হয়ে যাচ্ছে, জিভ দেখা যাচ্ছে। কালো রঙের একটা জিভ। মোবারকের মনে হল, মেয়েটার জিভটা রঙ করে দেবার দরকার ছিল। লাল টুকটুক চেহারার সঙ্গে কাল জিভ মিশ খাচ্ছে না।

ডাইরেক্টার সাহেব বললেন, তোমার নাম যেন কি বললে?

স্যার, মোবারক।

শোন মোবারক, তুমি চুপ করে বসে থাক। তোমার শট কখন নেব বুঝতে পারছি। প্রডাকশনের কেউ আছে? মোবারককে চা-বিস্কুট দে।

.

মোবারক লজ্জিত মুখে বসে আছে। সামান্য কয়টা টাকার জন্যে এই ঝামেলায়। আসাটা ঠিক হয়েছে কি না, বুঝতে পারছে না। মোবারক শুধু যে নিজে লজ্জা পাচ্ছে তা না, তার ধারণা তার ডান হাতটাও লজ্জার মধ্যে পড়েছে। আগে যেখানে আঙুল ছিল সেই জায়গা চুলকাচ্ছে। আঙুল নেই অথচ চুলকাচ্ছে–যাকে বলে ভৌতিক অবস্থা। এরকম তার মাঝে মাঝে হয়। লজ্জা বা অস্বস্তির মধ্যে পড়লে বেশি হয়। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না বলে মোবারক ব্যাপারটা কাউকে বলেনি, শুধু লতিফাকে বলেছে।

লতিফা গম্ভীর গলায় বলেছে, চুলকালে কি করেন? চুলকান?

হুঁ।

আঙুল তো নাই। কই চুলকান?

বাতাসের মধ্যে চুলকাই। এতে আরাম হয়।

লতিফা মোবারকের ছোট ভাই আবদুল করিমের স্ত্রী। দেড় বছর হল বিয়ে হয়েছে। এখনো ছেলেপুলে হয়নি বলে স্বভাব-চরিত্র নতুন বৌয়ের মত। লাল শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘুরঘুর করে, দেখতে ভাল লাগে। নতুন বৌ হল বাড়ির শোভা। মোবারকের প্রায়ই মনে হয়, প্রতিটি বাড়িতে একটা করে নতুন বৌ থাকা দরকার। সেজে-গুঁজে থাকবে, নতুন শাড়ি পরে ঘুরঘুর করবে।

মোবারকের এই মেয়েটাকে বড়ই পছন্দ। মেয়েটার সবই ভাল, শুধু হাসি-রোগ আছে। সব কিছুতেই হাসি। মোবারক হল তার ভাসুর। ভাসুরের সামনে হাসা খুব বড় ধরনের বেয়াদবি। এই মেয়ে সেটা জানে, জেনেও হাসে। তবে এই অপরাধ ক্ষমা করা যায়। সব ভাল জিনিসে খুঁত থাকে। সোনায় থাকে গিল্টি, চন্দ্রে কলঙ্ক। কি আর করা!

এই যে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে তার কাছেই চেয়ারে বসে আছে, তার জিভটা তো। কালো।

খালি গায়ে বসে থেকে মোবারক তার অদৃশ্য আঙুল চুলকায়। এক ঘন্টার উপর হল সে বসে আছে। ডাইরেক্টার সাহেব চা দিতে বলেছিলেন, সেই চা তাকে এখনো কেউ দেয়নি। তবে অনেকেই চা-বিস্কুট খাচ্ছে। মোবারক খুব ভাল করে চারদিকে দেখার চেষ্টা করছে। বাসায় গিয়ে এক ফাঁকে লতিফাকে বলতে হবে। বেচারী ছেলেমানুষ এইসব জিনিসে মজা পাবে। অতি ভাল একটা মেয়ে। ভাসুরের সামনে দুই একটা ছোটখাট বেয়াদবি করে ফেলে। বয়স কম বলেই করে। সব কিছু ধরলে সংসার। চলে না। কিছু ধরতে হয়, কিছু ছাড়তে হয়। তাছাড়া এই জামানায় কয়টা মেয়ে তার ভাসুরকে খাতির করে? সেই ভাসুর কাজের ভাসুর হলেও একটা কথা ছিল। মোবারক হল অকাজের ভাসুর। ছোট ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে-দাচ্ছে-ঘুমাচ্ছে। তাকে খাতির করার কি আছে? এই সব ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়। ছোট ভাইকে এবং তার স্ত্রীকে খাতির করে চলতে হয়। সব সময় খেয়াল রাখতে হয় এরা যেন বেজার না হয়। আবদুল করিমের ব্যাপারে মোবারক যে তা করে না, তাও না। করে, নিজের অজান্তেই করে। করার পর মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিজের উপর রাগে গা জ্বলে যায়।

গত সোমবারে রহমানিয়া হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে সে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ দেখে আবদুল করিম বাজার করে ফিরছে। দেখামাত্র সে হাতের সিগারেট ফেলে দিল। কি কাণ্ড! নিজের ছোট ভাই। তাকে দেখে সে সিগারেট ফেলবে কেন? ভাগ্যিস আবদুল করিম ব্যাপারটা দেখেনি। দেখলে একটা লজ্জার ব্যাপার হত।

দীর্ঘদিন চাকরি-বাকরি না থাকলে মন ছোট হয়ে যায়। তখন মানুষ ছোট ভাইকে দেখে সিগারেট ফেলে দেয়ার মত কাণ্ড-কারখানা করে বসে। তার মন যে ছোট হয়ে গেছে এটা মোবারক জানে। কিছুটা ছোট হয়ে থেমে গেলে হত। থামছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই ছোট হচ্ছে। বিশ্রী ব্যাপার। আবদুল করিমকে দেখলে ইদানীং তার কেমন জানি ভয় ভয় করে। চোখের উপর চোখ পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ নামিয়ে নেয়। অবশ্যি আবদুল করিমের কথা-বার্তার ধরনও এখন বদলে গেছে। আগে গলার স্বর চিকন ছিল, এখন মোটা হয়ে গেছে। কথা বলার সময় ভুল তালে পা নাচায়। কিছুদিন হল চোখে আবার চশমা পরেছে। মোবারকের ধারণা, এইসব হয়েছে বিয়ের কারণে। বিয়ে করলে পুরুষমানুষ বদলাবেই। তার উপর বউ যদি সুন্দরী হয় তাহলে তো কথাই নেই। নতুন বিয়ে করা পুরুষদের প্রধান কাজই হল বউকে দেখানো যে সে একটা বিরাট কিছু। কাজেই যে পুরুষের গলা চিকন সে অনেক কষ্ট করে মোটা গলায় কথা বলে। আশপাশের সবার দিকে এমন করে তাকায় যেন তারা কেউ মানুষ না, সে একাই মানুষ। শুধু মানুষ না, জ্ঞানী মানুষ।

সেদিন খাবার টেবিলে বসে আবদুল করিম জ্ঞানীদের মত কথা বলল। প্রথম কিছুক্ষণ পা নাচাল। প্রথমে ডান পা, তারপর বাঁ পা, তারপর দু'টাই একসঙ্গে। পা নাচানোর পর গলা খাঁকারি দিল। গলা পরিষ্কার করে নিল। অপরিষ্কার গলায় তো আর জ্ঞানের কথা বলা যায় না। গলা পরিষ্কার হবার পর বলল, লতু চশমটা দেখি। আদর করে লতিফাকে লতু ডাকা। স্ত্রীকে আদর করে ডাকবে না তো কাকে ডাকবে? লতু ফতু যা ইচ্ছা ডাকুক, কিন্তু বড় ভাইয়ের সামনে ডাকবে কেন? আদব-কায়দার একটা ব্যাপার আছে না? তাছাড়া স্ত্রীর সামনে যে ভঙ্গিতে সে কথা বলছে সেটা তো আদবের বড় খেলাফ। চশমা চোখে দিয়ে চশমা'র ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে কথা বলা। আরে ব্যাটা, তুই কি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নাকি? তুই হলি সাবরেজিস্টার অফিসের কেরানী। চশমা'র ফাঁক দিয়ে তোর কথা বলার দরকার কি? আর গলা মোটা করারও-বা দরকার কি? তোর যেমন গলা তুই তেমন গলায় কথা বলবি। এরকম মোটা গলায় বেশিদিন কথা। বললে তো গলায় ক্যানসার-ফ্যানসার হবে। মোবারক অবশ্যি ভাইয়ের সব কথা মাথা নিচু করে শুনল।

ভাইজান, আর কতদিন এই ভাবে বসে বসে থাকবেন? কিছু একটা করা দরকার?

মোবারক বলল, হুঁ।

তিনটা আঙুল কাটা গেছে, তার জন্যে তো আপনি অচল হয়ে পড়েননি। হাত নেই এমন মানুষও কাজ করে খাচ্ছে।

মোবারক মনে মনে বলল, ভিক্ষা করে খাচ্ছে। তুই কি তাই চাস? তোর বড় ভাই ভিক্ষা করলে তোর মান থাকবে?

বেঙ্গল টুলস যে আপনাকে দশ হাজার টাকা কমপেনসেশান দিবে বলেছিল, তার কি হল? সেই টাকাটা পেলেও তো একটা ব্যবসা-ট্যবসা শুরু করতে পারতেন। ওরা টাকাটা কবে দেবে কিছু বলেছে?

দিন-তারিখ কিছু বলে নাই।

দিবে তো? নাকি দিবে না?

দিবে।

গা ছেড়ে বসে থাকলে কি আর দিবে? ওদের তাগদা দিতে হবে। রোজ গিয়ে বসে থাকতে হবে। দিন-রাত ঘরে বসে থাকায় কোন লাভ নাই। লতু, পান দাও তো।

লতিফা পান আনতে যাচ্ছে এই ফাঁকে মোবারক উঠে পড়ল। পান খাওয়ার সময় সে সামনে থাকতে চায় না। তখন আবদুল করিম একটা বিশ্রী ব্যাপার করে। সেই বিশ্রী ব্যাপার দেখতে খারাপ লাগে। লতিফা যখন পান এনে দেয় তখন গদগদ ভঙ্গি করে আবদুল করিম হা করে। আবদুল করিমের মুখ ছোট, কিন্তু মুখের কাটা বিরাট বড়। হা করা মুখ বড় বিশ্রী দেখায়। লতিফাকে সেই হা করা মুখে পান ঢুকিয়ে দিতে হয়। এই। ব্যাপারগুলি আগে সে আড়ালে করত। ইদানীং মোবারকের সামনেই করছে। মোবারকের ধারণা, আজকাল তাকে তার ছোট ভাই মানুষ হিসেবেই গণ্য করছে না। কুকুর-বিড়াল ভাবছে। কুকুর-বিড়ালের সামনে মানুষ লজ্জা করে না। আবদুল করিমই বা কেন করবে?

ভাইজান, আপনি টাকাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।

আচ্ছা।

টাকাটা পেলে আমিও কিছু দিব। দু'টা মিলায়ে একটা দোকান-টোকান দেন। আপনার বয়সও তো কম হয় নাই। থিতি হয়ে ঘর সংসার করতে হবে না।

মোবারক মনে মনে বলল, চুপ থাক হারামজাদা। বক্তৃতা দিস না। বসে বসে পান খা। পা নাচা।

পান চলে এসেছে। আবদুল করিম চোখ বন্ধ করে হা করল। লতিফা মুখে পান ঢুকিয়ে দিল। পান খেতে খেতে বলল, বুঝলেন ভাইজান, আপনার যদি মেট্রিকটাও পাশ থাকত আমাদের অফিসে একটা ব্যবস্থা করে দিতাম। অফিসে এই জুনে লোক নিচ্ছে। আমাদের সাবরেজিস্ট্রার সাহেব বলতে গেলে আমার কথায় উঠেন বসেন। মুন্সিগঞ্জ বাড়ি। অতি অমায়িক।

মোবারক বুঝতে পারে সবই বউকে শোনানোর জন্যে চাল দেয়া কথা। কতবড় লায়েক হয়ে গেছে! মুখের কথায় চাকরি হয়ে যায়! সাবরেজিস্ট্রার তার কথায় উঠে বসে। সাবরেজিস্ট্রারের তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। কেরানীর কথায় উঠ-বোস করাই। একমাত্র কাজ। তুই হলি ড্রিল মাস্টার, তোর কথায় উঠ-বোস করবে? ফাজিলের ফাজিল।

ভাইজান, আপনি বেঙ্গল টুলসকে চাপ দিয়ে ধরবেন। কমপেনসেশান দেবে না মানে? তার বাপ দেবে। তেমন ঝামেলা করলে আমার লোক আছে, মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। শুধু তক্তা না, প্রয়োজনে তক্তায় বানিশ দিয়ে দেবে। হা হা হা।

এটা হল আবদুল করিমের রসিকতা। বিয়ের পর সে আবার রসিকও হয়েছে। রসিকতা করে নিজেই হা হা হি হি করে হাসে। তার মান রক্ষার জন্যে লতিফাকেও হাসতে হয়। মায়া লাগে মেয়েটার জন্যে। তক্তায় বার্নিশ দিয়ে দেবে এটা কি কোন হাসির কথা? এই কথা শুনে বেকুব ছাড়া কেউ হাসবে? অথচ মেয়েটাকে হাসতে হচ্ছে।

আবদুল করিম আবার হা করল। আরেকটা পান খাবে। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখাও শাস্তির মত। মোবারক চলে যেতে ধরেছে, আবদুল করিম বলল, ভাইজান, একটা কাজ করেন। আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দেন। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। লতু, টাকা এনে দাও। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দাও। ফাইভ ফাইভ আনবেন।

মোবারক জানে, সংসারে কাঁচা পয়সা আসতে শুরু করেছে। কেরানী ফাইভ ফাইভ সিগারেট খায় না। আবদুল করিম ইদানীং খাচ্ছে একটা ক্যাসেট প্লেয়ারও কেনা হয়েছে। নীল কাপড়ের ঢাকনি দিয়ে সেটা ঢাকা থাকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে সেই ক্যাসেট প্লেয়ার বেজে ওঠে। কয়েকদিন আগে রাত তিনটার সময় ক্যাসেট প্লেয়ার। বেজে উঠল–পায়েল বাজে ঝম ঝম…

ছোট ভাইয়ের জন্যে সিগারেট কিনতে দোকানে যাবার মধ্যে এক ধরনের অপমান আছে। মন ছোট হয়ে যায়। কিন্তু উপায় কি? মোবারক জানে, সিগারেট কেনার মধ্যেই অপমানের শেষ না, আরো খানিকটা বাকি আছে। সিগারেট কেনার পর পঞ্চাশ টাকা থেকে দু'টাকা ফেরত আসবে। আবদুল করিম উদাস ভঙ্গিতে বলবে, টাকা ফেরত দিতে হবে না, রেখে দেন। তাকে দেখে দেখে লতিফাও শিখবে। সকালে বাজার করে আনার পর বলবে, বাড়তি পয়সা ফেরত দিতে হবে না, রেখে দেন।

তার টাকাপয়সার দরকার অবশ্যই আছে। এক-দুই টাকাও কম কিছু না। দুই টাকায় এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি পাওয়া যায়। তারপরেও লজ্জা লাগে।

এই যে সে খালি গায়ে বসে আছে এটাও একটা লজ্জারই ব্যাপার। কখন না কখন ক্যামেরার সামনে নিয়ে যাবে তার জন্য সকাল থেকে খালি গায়ে বসে থাকার দরকার কি? এমন তো না যে তার শার্ট খুলতে এক ঘন্টা লাগে। বলবে আর সে ফট করে খুলে ফেলবে। অনেক বেলা হয়েছে। খিদে জানান দিচ্ছে। এক জায়গায় বসে থাকলে খিদে বেশি লাগে। কাজের মধ্যে থাকলে খিদেটা ভুলে থাকা যায়। কাজ আর কোথায়? মোবারকের মনে হচ্ছে সিনেমা লাইনের একমাত্র কাজই হল বসে থাকা। বেশিরভাগ মানুষই বসে আছে। পুতুলের মত লাল টুকটুক মেয়েটাও তার মতই সকাল থেকে চেয়ারে বসা। এরা মনে হয় এক ফাঁকে খেয়ে এসেছে। অনেকের মুখেই পান। পুতুল পুতুল মেয়েটাও পান খাচ্ছে। পান খাওয়ার জন্যে তার জিভটা লাল হবে কি না কে জানে। এক ফাঁকে দেখতে হবে। মেয়েটার নাম এখন মোবারক জানে। নাম হল কুমকুম। মেয়েটার স্বামী তাকে আদর করে কি ডাকবে–কুম? মোবারকের ডান হাতের কাটা পড়ে যাওয়া আঙুল চুলকাচ্ছে। কোন একজন ডাক্তারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলে হয়। পাড়ার সতীশ ডাক্তার আছে, এলএমএফ হলেও ভাল ডাক্তার। এমবি ডাক্তারের চেয়ে ভাল। তাকে বললে সে কি চুলকানির কোন ট্যাবলেট –ফ্যাবলেট দেবে? সতীশ ডাক্তারের সঙ্গে তার আলাপ আছে। রাস্তায় দেখা হলে জিজ্ঞেস করেন–কি মোবারক, খবর কি? তোমার ভাইয়ের এসিডিটি কমেছে? ভাজা-পোড়া কম খেতে বলবে। মোবারক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে–জ্বি আচ্ছা, বলব। যদিও সে ভালমতই জানে বলার প্রশ্নই আসে না। সব ছোট ভাইদের উপদেশ দেয়া যায় না। কিছু কিছু ছোট ভাই আছে, যাদের কাছ থেকে শুধু উপদেশ শুনতে হয়। কিছু কিছু ছোট ভাই আছে যাদের তুমি করে বলতেও অস্বস্তি লাগে। মোবারক তো একবার আপনি বলেই ফেলেছিল। কি লজ্জার ব্যাপার। তবে আবদুল করিম অন্যমনস্ক ছিল বলে বুঝতে পারেনি। হয়েছে কি, আবদুল করিম ইউরিন টেস্ট করাবে। পেচ্ছাব ভর্তি শিশি মোবারকের হাতে দিয়ে বলল, সাবধানে নিয়ে যান। রাস্তায় যেন না ভাঙে। মোবারক ঘাড় কাত করে বলল, জ্বি আচ্ছা। ছোট ভাইকে আপনি করে বলা লোকে শুনলে ছিঃ ছিঃ করবে। তবে দিনে দিনে অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে তাতে মনে হয় খুব শিগগিরই সে আপনি বলা শুরু করবে। কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? বিছানা-বালিশ নিয়ে হাঁটা দেয়া? কিছু ব্যবস্থা কি আর হবে না? রেল স্টেশনে গিয়ে শুয়ে থাকা। সরকারি জায়গা, কারো কিছু বলার নেই। তবে তোক জানাজানি হবে। তাতে আবদুল করিমেরই অপমান। নিজের ছোট ভাই, তার অপমান হতে দেয়া যায় না। ভাই তেমন খারাপ কিছুও না। তিন বছর ধরে তো তার ঘাড়ে বসেই খাচ্ছে। এখনো তো বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। দুজনের আলাদা সংসারের কত মজা। মোবারকের কারণে তাদের সেই মজা হচ্ছে না। ওদের দিকটাও তো দেখতে হবে।

রাত দশটার পর থেকে ক্ষুধায় মোবারক চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। তার মনে হচ্ছে গত কয়েক বছর এমন খিদে তার লাগেনি। খিদের চোটে মাথার ভেতরে পর্যন্ত। ভো ভো শব্দ হচ্ছে। তার পাশে রাখা সবুজ শার্টটায় কেউ লবণ মাখিয়ে দিলে সে সজি। মনে করে খেয়ে ফেলতে পারে এমন অবস্থা। লাল টুকটুক মেয়েটাও চলে গেছে। মোবারকের অংশটা কখন হবে সে বুঝতে পারছে না। ডাইরেক্টার সাহেব একবার কিছুক্ষণের জন্যে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে ইচ্ছা করলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারত। সাহসে কুলায়নি, কারণ তাকে দেখাচ্ছিল পাগলের মত। তার নাকি প্রেশারের সমস্যা আছে। কিছুক্ষন আগে মাথায় পানি ঢেলেছেন। চুল বেয়ে এখনো ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। চোখ লাল। এরকম অবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না।

মোবারকের বাথরুমও পেয়েছে। মনে হচ্ছে পেতলের বড় কলসিতে এক কলসি পানি পেটে জমা হয়েছে। জায়গা ছেড়ে যেতে সাহসে কুলাচ্ছে না। কখন তার ডাক পড়বে কিছু বলা তো যায় না। বারশ টাকা নগদানগদি পাওয়ার কথা। যে তাকে এনে দিয়েছে সে তাই বলেছে। বারশ টাকা পেলেও দুশ টাকা তাকে কমিশন দিতে হবে। হাতে থাকবে এক হাজার, সেটাও কম কি? একটা লোক সারাদিন মাটি কেটে পায় ষাট টাকা। আর সে আঁ বলে একটা চিৎকার দিয়ে পাবে বারশ টাকা। বিশ্বাস হতে চায় না। তবে ফিল্মের সব ব্যাপারই তো অবিশ্বাস্য। হতেও পারে। দেখা যাক। টাকাটা পেলে লতিফাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে। বিয়েতে কিছু দেয়নি অথচ সে হল ভাসুর। হাজারখানিক টাকায় সোনার কিছু পেলে তাই দিত। শাড়ি তো আর থাকবে না। সোনাটা থাকবে। নিজের মেয়েদের গল্প করতে পারবে–এটা আমার ভাসুর দিয়েছেন। মেয়েরা এই জাতীয় গল্প করতে খুব পছন্দ করে। কোন্ গয়না কে দিয়েছে এটা তাদের একশ বছর পরেও মনে থাকে।

রাত সাড়ে বারটার সময় ডাইরেক্টার সাহেব তার কাছে এসে বললেন, কি যেন নাম তোমার?

স্যার, মোবারক।

শোন মোবারক, তোমার অংশটা আজ হচ্ছে না।

কবে হবে স্যার?

বলা যাচ্ছে না। নাও হতে পারে। বিগ স্ক্রিনে আঙুল কাটাকাটি ভাল লাগবে না। যাই হোক, তুমি তোমার ঠিকানা রেখে যাও। প্রয়োজনে খবর দিব। প্রডাকশনের কে আছে এখানে? মোবারককে রিকশা ভাড়া দিয়ে দে।

.

স্টুডিওর গেট থেকে বেরুতে বেরুতে একটা বেজে গেল। টাউন সার্ভিস বন্ধ। হেঁটে বাসায় ফেরা ছাড়া উপায় নেই। রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়নি। যার দেবার কথা সে গম্ভীর মুখে বলেছে, সব বড় নোট। ভাংতি নাই। আরেক দিন এসে রিকশা ভাড়া নিয়ে যাবেন।

মোবারকের পকেটে দু'টা মাত্র টাকা। হাঁটা ছাড়া উপায় কি? প্রায় চার মাইল পথ। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা। এত রাতে ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। আবদুল করিমের আবার ঘুমের অনেক নিয়ম-কানুন আছে। একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না। রাত তিনটায় বাড়ি ফেরাটা সে কিভাবে নেবে সেটাও একটা কথা। রেল স্টেশনে রাতটা কাটিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ফেরাই সবচেয়ে ভাল। কিন্তু খিদেটা অসম্ভব। কষ্ট দিচ্ছে। বাসায় ফিরে চারটা ভাত না খেলেই না। লতিফা ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত দেবে না। ভাত তরকারি সব গরম করবে। লেবু থাকলে লেবু কেটে দেবে। একবার সে কাঁচামরিচ চেয়েছিল। ঘরে কাঁচামরিচ ছিল না। সে শুকনো মরিচ পুড়িয়ে তেল দিয়ে মেখে দিয়েছে। এটা কোন মেয়ে করে না। লতিফা করে। তার জন্যে শাড়িটা কেনা গেল না। এটা একটা আফসোস।

গেটের সামনে এসে মোবারক অবাক। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। আবদুল করিম বসে আছে বারান্দায়। তার পাশে লতিফা। মোবারককে দেখে আবদুল করিম কিছু বলল না। উঠে ভেতরে চলে গেল। লতিফা বলল, আপনি কোথায় ছিলেন ভাইজান? সে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। দুশ্চিন্তা করলে তার হাঁপানির টান উঠে। আমি তো আর সেটা জানি না। রাত একটা থেকে হাঁপানির টান উঠেছে। বারান্দায় বসে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। আমি ভয়ে অস্থির।

মোবারক লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল।

লতিফা বলল, ভাত খেয়ে এসেছেন?

না।

হাত-মুখ ধুয়ে আসেন ভাত দেই। কোথায় ছিলেন বলেন তো!

ভাত খাওয়ার সময় লতিফা সামনে থাকে। আজ নেই। না থাকলেই ভাল। আরাম করে খাওয়া যায়। অন্যের সামনে বিশ্রী ভঙ্গিতে দুআঙুলে নলা করে ভাত মুখে তুলতে ভাল লাগে না।

হাত ধোয়ার সময় লতিফা শুকনো মুখে সামনে দাঁড়াল।

ভাইজান, ওর হাঁপানির টানটা তো কমছে না। কেমন কেমন করে যেন শ্বাস নিচ্ছে। আমার তো খুব ভয় লাগছে। আপনি একটু এসে দেখে যান।

আসতেছি। তুমি কোন চিন্তা করবা না। ওর এইটা পুরানা অসুখ। ছোটবেলায় কত হয়েছে। একবার হল কি, ইস্কুলের কিছু দুষ্ট ছেলে আমাকে ধরে খুব মা'র দিল। নাক দিয়ে রক্ত-টক্ত বের হয়ে বিশ্রী অবস্থা। তাই দেখে করিমের হাপানির টান উঠে গেল। এখন-তখন অবস্থা, তাকে নিয়ে গেলাম সদর হাসপাতালে। চিন্তা কর অবস্থা! ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তের বন্ধন তো। এই কারণে এরকম হয়।

আবদুল করিমের অবস্থা আসলেই খারাপ। শোঁ শোঁ শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে। মোবারককে দেখে সে চি চি করে ডাকল–ভাইজান!

মোবারক বলল, কথা বলিস না। চুপ করে শুয়ে থাক। আমি সতীশ ডাক্তারকে নিয়ে আসি।

অনেকদিন পর ভাইকে তুই বলল। তুই বলতে গিয়ে তার গলা ব্যথা করতে লাগল।

রাস্তাঘাট ফাঁকা। ফাঁকা রাস্তায় মোবারক এগুচ্ছে। তার কাটা আঙুলের চুলকানিটা এখন নেই। সতীশ ডাক্তারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে হয়। বড়ই রহস্যময় ব্যাপার। জগৎটাই রহস্যময়।

.

এই অঞ্চলের সবকটা স্ট্রিট লাইট নষ্ট। শেষ রাতের চাঁদের আলোয় চারদিক আবছা আবছা দেখাচ্ছে। কলঙ্ক ভরা চাঁদের আলো এত সুন্দর কেন? এই ধরনের উচ্চ শ্রেণীর দার্শনিক চিন্তা করতে করতে মোবারক লম্বা লম্বা পা ফেলছে। দার্শনিক চিন্তার কারণেই বোধহয় তার চোখ একটু পরপরই জলে ভিজে যাচ্ছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top