What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected প্রিয়পদরেখা (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
একজন ক্রীতদাস



কথা ছিল পারুল নটার মধ্যে আসবে।

কিন্তু এল না। বারোটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম একা একা। চোখে জল আসবার মতো কষ্ট হতে লাগল আমার। মেয়েগুলি বড খেয়ালি হয়।

বাসায় এসে দেখি ছোট্ট চিরকুট লিখে ফেলে গেছে। সন্ধ্যায় ৬৯৭৬২১ নম্বরে ফোন করো—পারুল। তাদের পাশের বাড়ির ফোন। আগেও অনেকবার ব্যবহার করেছি। কিন্তু আজ তাকে ফোনে ডাকতে হবে কেন? অনেক আলাপআলোচনা করেই কি ঠিক করা হয় নি আজ সোমবার বেলা দশটায় দুজন টাঙ্গাইল চলে যাব। সেখানে হারুনের বাসায় আমাদের বিয়ে হবে।

সারা দুপুর শুয়ে রইলাম। হোটেল থেকে ভাত এনেছিল। সেগুলি স্পর্শও করলাম না। ছোটবেলায় যেরকম রাগ করে ভাত না-খেয়ে থেকেছি আজও যেন রাগ করবার মতো সেরকম একটি ছেলেমানুষি ব্যাপার হয়েছে। পারুলের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়েছে— এই ভাবতে-ভাবতে নিজেকে খুব তুচ্ছ ও সামান্য মনে হতে লাগল। সন্ধ্যাবেলা টেলিফোন করবার জন্যে যখন বেরিয়েছি তখন অভিমানে আমার ঠোট ফুলে রয়েছে। গ্রিন ফার্মেসির মালিক আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, অসুখ নাকি ভাই?

আমি শুকনো গলায় বললাম, একটা টেলিফোন করব।

পারুল আশেপাশেই ছিল। রিনরিনে ছয়-সাত বছর বয়েসের ছেলেদের মতো গলা যা শুনলে বুকের মধ্যে সুখের মতো ব্যথা বোধ হয়।

হ্যালো শোন, কিন্ডারগার্টেনের মাস্টারিটা পেয়েছি। শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? বডড ডিস্টার্ব হচ্ছে লাইনে।

পারুলের উৎফুল্ল সতেজ গলা শুনে আমি ভয়ানক অবাক হয়ে গেলাম। তোতলাতে তোতলাতে কোনোরকমে বললাম, আজ নটার সময় তোমার আসর কথা ছিল…।

মনে আছে, মনে আছে। শোন তারিখটা একটু পিছিয়ে দাও। এখন তো আর সে রকম ইমার্জেন্সি নেই। তা ছাড়া…।

তা ছাড়া কী? তোমার ব্যবসার এখন যা অবস্থা বিয়ে করলে দুজনকেই একবেলা খেয়ে থাকতে হবে।

হড়বড় করে আরো কী কী যেন সে বলল। হাসির শব্দও শুনলাম একবার! আমি বুঝতে পারলাম পারুল আর কখনোই আমাকে বিয়ে করতে আসবে না। কাল তাকে নিয়ে ঘর সাজাবার জিনিসপত্র কিনেছি। সারা নিউমার্কেট ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সে কেনাকাটা করেছে। দোকানিকে ডবল বেডশিট দেখাতে বলে সে লজ্জায় মুখ লাল করেছে। এবং আজ সন্ধ্যাতেই খুব সহজ সুরে বলছে, তোমার ব্যবসার এখন যা অবস্থা। আঘাতটি আমার জন্যে খুব তীব্র ছিল। আমার সাহস কম, নয়তো সে রাতেই আমি বিষ খেয়ে ফেলতাম কিংবা তিনতলা থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়তাম। আমি বড় অভিমানী হয়ে জন্মেছি।

সে বৎসর আরো অনেকগুলি দুর্ঘটনা ঘটল। ইরফানের কাছে আমার চার হাজার টাকা জমা ছিল। সে হঠাৎ মারা গেল। রামগঞ্জে এক ওয়াগন লবণ বুক করেছিলাম। সেই ওয়াগনটি একেবারে উধাও হয়ে গেল। পাথরকুঁচি সাপ্লাইয়ের কাজটায় বড় রকমের লোকসান দিলাম। দ্রভাবে থাকবার মতো পয়সাতেও শেষপর্যন্ত টান পড়ল। মেয়েরা বেশ ভালো আন্দাজ করে। পারুল সত্যি-সত্যি আমার ভবিষ্যণ্টা দেখে ফেলেছিল। পারুলের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল। আমি নিজে কখনো যেতাম না তার কাছে। তবু তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত। হয়তো বাসস্টপে দুজন একসঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছি। পারুল আমাকে দেখামাত্রই আন্তরিক সুরে বলেছে, কী আশ্চর্য, তুমি! একী স্বাস্থ্য হয়েছে তোমার? ব্যবসাপত্র কেমন চলছে?

চলছে ভালোই।

ইশ বড় রোগা হয়ে গেছ তুমিচা খাবে এক কাপ? এস তোমাকে চা খাওয়াব।

দুপুরবেলা সিনেমা হলের সামনে একদিন দেখা হয় গেল। আমি তাকে দেখতে পাই নি এরকম একটা ভান করে রাস্তায় নেমে পড়লাম। কিন্তু সে পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, এই এই। সিনেমা দেখতে এসেছিলে নাকি?

না।

শোন, একটা কথা শুনে যাও।

কী?

আমার এক বান্ধবীর ছেলের আজ জন্মদিন। প্লিজ একটা উপহার আমাকে চয়েস করে দাও। চল আমার সাথে।

পারুলকে যতবার দেখি ততবারই অবাক লাগে। তিনশ টাকার স্কুল মাস্টারি তাকে কেমন করে এতটা আত্মবিশ্বাসী আর অহংকারী করে তুলেছে, ভেবে পাই না। ভুলেও সে আমাদের প্রসঙ্গ তুলে না। এক সোমবারে আমরা যে একটি বিয়ের দিন ঠিক করেছিলাম তা যেন বান্ধবীর ছেলের জন্মদিনের চেয়েও অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার। তার উজ্জ্বল চোখ, দ্রুত কথাবলার ভঙ্গি স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয় জীবন অনেক অর্থবহ ও সুরভিত হয়ে হাত বাড়িয়েছে তার দিকে।

এপ্রিল মাসের তেরো তারিখে পারুলের বিয়ে হয়ে গেল। নিমন্ত্রণের কার্ড পাঠিয়ে সে যে আমাকে তার একটি নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখায় নি সেইজন্যে আমি তাকে প্রায় ক্ষমা করে ফেললাম। সেদিন সন্ধ্যায় আমি একটি ভালো রেস্টুরেন্টে খেয়ে অনেকদিন পর সিনেমা দেখতে গেলাম। সিনেমার শেষে বন্ধুর বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত হৃষ্টমনে গল্প করতে লাগলাম। এমন একটা ভাব করতে লাগলাম যেন পারুলের বিয়েতে আমরি বিশেষ কিছুই যায় আসে না। একজনের সঙ্গে বিয়ের কথা ঠিক করে অন্য একজনকে বিয়ে করা যেন খুব একটা সাধারণ ব্যাপার—অহরহই হচ্ছে।

সে রাতে ঘরের বাতাস আমার কাছে উষ্ণ ও অর্জি মনে হতে লাগল। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এল না। শুয়ে-শুয়ে ক্রমাগত ভাবলাম ব্যবসার অবস্থাটা অল্প একটু ভালো হলেই একটি সরল দুঃখী-দুঃখী চেহারার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলব। এবং সেই মেয়েটির সঙ্গে পারুলের হৃদয়হীনতার গল্প করতে-করতে হা-হা করে হাসব।

কিন্তু দিনদিন আমার অবস্থা আরো খারাপ হল। একটা ছোটখাটো কনট্রাক্ট নিয়েছিলাম। তাতে সঞ্চিত টাকার সবটাই নষ্ট হয়ে গেল। একেবারে ডুবে যাবার মতো অবস্থা। চাকর ছেলেটিকে ছাড়িয়ে দিতে হল। দু-একটি শৌখিন জিনিসপত্র (একটি থ্রি ব্যান্ড ফিলিপস্ ট্রানজিস্টার, একটি ন্যাশনাল রেকর্ড প্লেয়ার, একটি দামি টেবিল ঘড়ি) যা বহু কষ্ট করে কৃপণের মতো পয়সা জমিয়ে-জমিয়ে কিনেছি, বিক্রি করে দিলাম। এবং তারপরও আমাকে একদিন শুধু হাফ-পাউন্ডের একটি পাউরুটি খেয়ে থাকতে হল।

সহায়-সম্বলহীন একটি ছেলের কাছে এ শহর যে কী পরিমাণ হৃদয়হীন হতে পারে তা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। নিষ্ঠুর এবং অকরুণ এই শহরে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম । সে সময় সারাক্ষণই খিদের কষ্ট লেগে থাকত। ফুটপাতের পাশে চটের পর্দার আড়ালে ভাতের দোকানগুলি দেখলেই মন খারাপ হয়ে যেত। দেখতাম রিকশাঅলা শ্রেণীর লোকরা উবু হয়ে বসে গ্রাস পাকিয়ে মহানন্দে ভাত খাচ্ছে। চুম্বকের মতো সেই দৃশ্য আমাকে আকর্ষণ করত। আহ ওরা কী সুখেই আছে।—এইরকম মনে করে আমার চোখ ভিজে উঠত। আমি বেঁচে থাকার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। নিউ ইংক কালি কোম্পানির সেলসম্যানের চাকরি নিলাম একবার। একবার কাপড়কাচা সাবানের বিজ্ঞাপন লেখার কাজ নিলাম। পারুলকে আমার মনেই রইল না। বেমালুম ভুলে গেলাম।

একদিন সন্ধ্যাবেলী মোহাম্মদপুর বাজারের কাছ দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি পারুল্ল । সঙ্গে ফুটফুটে একটি বাচ্চা। পায়ে লাল জুতো, মুখটি ডল-পুতুলের মতো গোলগাল। পারুলের শাড়ির আঁচল ধরে টুকটুক করে হাঁটছে। পারুল যাতে আমাকে দেখতে না পায় সেইজন্যেই আমি সুট করে পাশের গলিতে ঢুকে পড়লাম । অথচ তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। পারুলের সমস্ত ইন্দ্রিয় তার মেয়েটিতে নিবদ্ধ ছিল। মাত্র এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল এই চমৎকার ডল-পুতুলের মতো মেয়েটি আমার হতে পারত। কিন্তু পরক্ষণেই সোবহান মিয়া হয়তো আমাকে কাজটা দেবে না— এই ভাবনা আমাকে অস্থির করে ফেলল।

আমার ভাগ্য ভালো। কাজটা হয়ে গেল । রোজ সকালে সেগুনবাগিচা থেকে হেঁটে হেঁটে মোহাম্মদপুরে আসি। সমস্ত দিন সোবহান মিয়ার ইন্ডেন্টিং ফার্মের হিসাব-নিকাশ দেখে অনেক রাতে সেগুনবাগিচায় ফিরে যাই। নিরানন্দ একঘেয়ে ব্যবস্থা। গভীর রাতে মাঝে-মধ্যে ঘুম ভেঙে গেলে মরে যেতে ইচ্ছে করে। রাস্তায় আমি মাথা নিচু করে হাঁটি। পরিচিত কেউ আমাকে উচ্চস্বরে ডেকে উঠুক তা এখন আর চাই না। কিন্তু তবু পারুলের সঙ্গে আরো দুবার আমার দেখা হয়ে গেল। একবার দেখলাম হুড-ফেলা রিকশায় সে বসে, চোখে বাহারি সানগ্লাস। তারপাশে চমৎকার চেহারার একটি ছেলে (খুব সম্ভব এই ছেলেটিকেই সে বিয়ে করেছে কারণ সফিকের কাছে শুনেছি পারুলের বর হ্যান্ডসাম এবং বেশ ভালো চাকরি করে)। দ্বিতীয়বার দেখলাম অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে হাসতে-হাসতে যাচ্ছে। কোনোবারই সে আমাকে দেখতে পায় নি। অবিশ্যি দেখতে পেলেও সে আমাকে চিনতে পারত না । অভাব, অনাহার ও দুর্ভাবনা আমার চেহারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল । তাছাড়া পুরনো বন্ধুদের করুণা ও কৌতূহল থেকে বাঁচবার জন্যে আমি দাড়ি রেখেছিলাম। লম্বা দাড়ি ও ভাঙা চোয়ালই আমার পরিচয়কে গোপন রাখবার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তবু আমি হাত দুলিয়ে অন্যরকম ভঙ্গিতে হাঁটা অভ্যাস করলাম। যার জন্যে সফিক (যার সঙ্গে এক বিছানায় অনেকদিন ঘুমিয়েছি) পর্যন্ত আমাকে চিনতে পারে নি। চেহারা পরিচিত মনে হলে মানুষ যেরকম পিটপিট করে দুএকবার তাকায় তাও সে তাকায় নি।

আমি নিশ্চিত, পারুলের সঙ্গে কোনো একদিন চোখাচোখি হবে। এবং সেও চিনতে না পেরে সফিকের মতো ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে যাবে। কিন্তু পারুল আমাকে এক পলকে চিনে ফেলল। আমাকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দু এক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারল না। আমি খুব স্বাভাবিক গলায় বললামভালো আছ পারুল? অনেকদিন পরে দেখা। আমার খুব একটা জরুরি কাজ আছে। যাই তাহলে কেমন?

পারুল আশ্চর্য ও দুঃখিত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি যখন চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছি তখন সে কথা বলল, তোমার এমন অবস্থা হয়েছে?

আমি অল্প হাসির ভঙ্গি করে হালকা সুরে বলতে চেষ্টা করলাম, ব্যবসাটা ফেল মেরেছে পারুল। আচ্ছা যাই তাহলে?

পারুল সে কথার জবাব দিল না। আমি বিস্মিত হয়ে দেখি তার চোখে পানি এসে পড়েছে। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল।

পারুলকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। যে জীবন আমার শুরু হয়েছে সেখানে প্রেম নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু সামান্য কয়েক ফোঁটা মূল্যহীন চোখের জলের মধ্যে পারুল্ল নিজেকে আবার প্রতিষ্ঠিত করল। সমস্ত দুঃখ ছাপিয়ে তাকে হারানোর দুঃখই নতুন করে অনুভব করলাম।

আমার জন্যে এই দুঃখটার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top