সন্তান জন্মদানের জন্য প্রয়োজন নারীর ডিম্বাণু আর পুরুষের শুক্রাণু। একটি সুস্থ-সবল শুক্রাণুর দ্বারা একটি পরিপক্ব ডিম্বাণুর নিষেক ঘটা এবং এই নিষিক্ত ডিম্বাণু বা ভ্রূণের জরায়ুর মধ্যে নিরাপদে ভালোভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করাটা জরুরি। এই যাত্রা সহজ নয়। বিভিন্ন পর্যায়ে তৈরি হতে পারে নানা বাধা। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের নানা শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি পরিবেশদূষণ একটি অন্যতম প্রতিকূলতা। রোগবালাই নিয়ে যতটা মাথা আমরা ঘামাই, পরিবেশ দূষণের দিক নিয়ে ততটা চিন্তা করি না। আজ সে বিষয় নিয়েই কথা বলছি।
পরিবেশের যেসব বিষয় প্রজননে প্রভাব ফেলে, সেগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—
১. ভারী ধাতব পদার্থ
ভারী ধাতব পদার্থ মাটি, পানি এবং খাবারে জমা হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। খুব সহজে এগুলো নষ্ট হয় না বলে দীর্ঘদিন শরীরে রয়ে যায়। কপার, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম খুব স্বল্পমাত্রায় দৈহিক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজন হলেও উচ্চমাত্রায় এগুলো বিষাক্ত। আবার শারীরবৃত্তীয় কাজে ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, সিসার কোনো প্রয়োজন নেই এবং যেকোনো মাত্রায় এগুলো বিষাক্ত।
খাওয়ার পানি, নদী ও সমুদ্রের মাছ নানা ভারী ধাতব পদার্থে দূষিত হয়ে থাকে। ধাতব দূষিত মাছ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান, রিচার্জেবল ব্যাটারি, অলংকার, রং, খেলনা, বুলেট থেকে ভারী ধাতব দূষণ হতে পারে। ক্রমাগত ভারী ধাতবের দূষণে নানা ধরনের ক্যানসার হতে পারে, হতে পারে এন্ডোমেট্রিওসিস, পিসিওএস (পলিসিসটিক ওভারি সিনড্রোম), গর্ভপাত, জরায়ুর ভেতর শিশুমৃত্যু, অপরিণত শিশু প্রসব, ফার্টিলিটি বা উর্বরতা হ্রাস, এমনকি ওভারিয়ান ফেলিউর। ভারী ধাতব পদার্থ পুরুষ ও নারী উভয়েরই ফার্টিলিটি কমায়, তবে মেয়েদের ওপর এর প্রভাব বেশি।
মার্কারি: কয়লা ও ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো, খনি এবং শিল্পকারখানার উচ্ছিষ্ট, ভাঙা থার্মোমিটার, ফ্লুরোসেন্ট বাতি তৈরির কারখানা ইত্যাদি মার্কারির উৎস। এটি এস্ট্রোজেনের কার্যকারিতা পরিবর্তন করে। এ থেকে হতে পারে গর্ভপাত, অপরিণত প্রসব এবং জন্মত্রুটি।
সিসা: সিসামিশ্রিত রং দেওয়া দরজা–জানালা খোলা ও বন্ধের সময়ে ঘর্ষণের ফলে সিসার কণা নিঃসৃত হয়। বর্জিত ব্যাটারি ও সিসামিশ্রিত রঙের পাত্রের ক্ষুদ্রাংশ দ্বারা মাটি দূষিত হয়। পানির পাইপের সিসার প্রলেপে খাবার পানিদূষণ, সিসার প্রলেপের পাত্র থেকে খাবার দূষণ হয়। এমনকি প্রসাধনী যেমন কাজল থেকেও সিসার দূষণ হয়ে থাকে। ব্যাটারির কারখানা, জুয়েলারি কারখানায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সিসা দূষণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দীর্ঘ সময় দূষণের ফলে হরমোনের উৎপাদন কমে যায়। সিসা শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর জন্য বিষাক্ত। এর প্রভাবে অনিয়মিত মাসিক, গর্ভপাত এবং মৃত শিশুর জন্ম হয়। সিসা দূষণের কারণে মায়ের পেটে থাকা মেয়েশিশুদের ডিম্বাশয় তৈরিতে বিঘ্ন ঘটে। রক্তে ৩৫ মাইক্রন সিসা থাকলেই হরমোন তৈরি কমে যায়, বেড়ে যায় গর্ভপাত ও জন্মগত ত্রুটি।
ক্যাডমিয়াম: বছরের পর বছর ক্যাডমিয়ামে উন্মুক্ত থাকলে তা শরীরে জমা হতে থাকে। চুল, নখ, মুখের লালা, প্রস্রাব এবং রক্তে জমা হয়। এটি একবার শরীরে প্রবেশ করলে ১০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত শরীরে থেকে যায়। রিচার্জেবল ব্যাটারি এবং ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার যেমন সবজি, ডাল, আলু, পালংশাক ক্যাডমিয়াম দূষণের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। তবে মূল উৎস হলো ধুলাবালু ও ধোঁয়া, বিশেষ করে সিগারেটের ধোঁয়া।
এটি প্রজেস্টেরন হরমোন উৎপাদনে বাধা দেয়। এর দূষণে বিলম্বিত বয়োসন্ধি, অনিয়মিত মাসিক, গর্ভপাত, অপরিণত প্রসব, কম ওজনের সন্তান প্রসব হয়। যে নারীদের আয়রন ঘাটতি থাকে, তাঁদের খাদ্যনালিতে ক্যাডমিয়ামের শোষণ বেশি হয়।
জিংক: জিংকের ঘাটতি ডিম্বাণুর পরিপক্বতা অর্জনে বাধারসৃষ্টি করে। ফলে ব্যাহত হয় ওভুলেশন বা ডিম্বস্ফুটন। অপরিণত বয়সে প্রসব, জন্মের সময় কম ওজন, জন্মগত ত্রুটি এবং পরিণত বয়সে সহজে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। উল্টো দিকে জিংকের উচ্চমাত্রা ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করে, ফলে জন্মগত ত্রুটি থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
২. বায়ুদূষণ
ধুলাবালু,কলকারখানার ধোঁয়া, ইটভাটার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া, সিগারেটের ধোঁয়া, কীটনাশক ইত্যাদি দিয়ে দূষিত হচ্ছে বাতাস। সালফার ডাই–ক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ওজোন, বেনজোপাইরিন, অরগানিক কম্পাউন্ড, ভারী ধাতব পদার্থ এবং ক্ষুদ্র কণা উল্লেখযোগ্য দূষক।
পুরুষ ও নারী উভয়েরই প্রজনন প্রক্রিয়ায় বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। পুরুষের শুক্রাণু ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, হারাচ্ছে গতিশীলতা, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আকৃতি। ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা। নারীদের ডিম্বাণুর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র কণা ২ দশমিক ৫ ওভারির ফলিকল নষ্ট করে দেয়। কিউবিক মিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম ক্ষুদ্র কণা ২ শতাংশ ফার্টিলিটি কমিয়ে দেয়। হরমোনের কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, ফলে ডিম্বাণু পরিপক্ব হতে পারে না। কলকারখানাসমৃদ্ধ এলাকা, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি, সেখানে নারীদের ডিম্বাণুর উপস্থিতির নির্দেশিকা এএমএইচ অনেক কম থাকে।
৩. ব্যাহত হচ্ছে প্রজনন হরমোনের কার্যকারিতা
বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য হরমোনের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটায়। এসব রাসায়নিক দ্রব্যকে বলে এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর। প্রকৃত হরমোন তৈরি এবং এর কার্যক্রমে তারা বাধার সৃষ্টি করে, হরমোনের প্রতি শরীরের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়। ফলে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, আচরণ, ফার্টিলিটিতে ব্যাঘাত ঘটায়। বিভিন্ন রকম জন্মগত ত্রুটি এবং বিকাশজনিত সমস্যা তৈরি করে।
প্লাস্টিকের পাত্র ও বোতল, প্লাস্টিকের ফিডার, পিভিসি ম্যাট, টিনজাত খাবার, প্রসাধনী, ননস্টিক হাঁড়ি–পাতিল ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর বিপিএ (বিস্ফোনেল এ) ও থ্যালেট থাকে। প্লাস্টিকের পাত্রে মাইক্রোওভেনে খাবার গরম করলে অতি সহজে নিঃসৃত হয়ে খাবারে মিশে যায়।
এগুলো দূষণে ডিম্বাণুর সংখ্যা হ্রাস, বিপিএ পিসিওস এবং এন্ডোমেট্রিওসিস নামের রোগ, ফলশ্রুতিতে ইনফার্টিলিটি হয়। উচ্চমাত্রার বিপিএ গর্ভপাত এবং কম ওজনের নবজাতকের জন্য দায়ী।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন
অতিরিক্ত তাপ শুক্রাণু, ডিম্বাণু ও ভ্রূণ তৈরিতে বাধার সৃষ্টি করে। গরমে প্রোজেস্টেরন হরমোন তৈরি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার ফলে ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়।
সমাধান কী
কীটনাশকের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। প্রজননের উপযোগী নারীরা এবং পরিবারের শিশুরা কম মার্কারিযুক্ত খাবার খাবেন। প্রসাধনীতে সিসার ব্যবহার কমাতে হবে। সন্তানপ্রত্যাশী দম্পতি, গর্ভবতী নারী এবং শিশুরা সম্ভব হলে অরগানিক খাবার খাবে। শিল্পকারখানা–অধ্যুষিত এলাকায়, পুরোনো বাড়ি সংস্কারের সময়, ঘরের কাজ যেমন কার্পেট, ম্যাট্রেস পরিষ্কার করার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যাঁরা ফসলের কাজ করেন, কাজ শেষে তাঁরা ভালো করে হাত ধোবেন, মাস্ক ব্যবহার করবেন এবং জুতা বাড়ির বাইরে রাখবেন। বেশি দূষিত এলাকায় বাড়িতে হেপা ফিল্টার ব্যবহার করতে হবে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহারে উপকার আছে।
প্লাস্টিকের বোতল এবং পাত্রের নিরাপদ সিল দেওয়া ব্র্যান্ড, যা বিপিএমুক্ত দেখে ব্যবহার করা উচিত। ৩, ৬, ও ৭ নম্বরখচিত প্লাস্টিকের পাত্র পরিহার করতে হবে। প্লাস্টিকের পাত্রের বদলে কাচের বা স্টেইনলেস স্টিলের পাত্র ব্যবহার করতে হবে। মাইক্রোওভেনে প্লাস্টিকের পাত্র দেওয়া যাবে না। আয়রনের প্রলেপযুক্ত থ্যালেটমুক্ত ননস্টিক হাঁড়ি–পাতিল ব্যবহার করা নিরাপদ। ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং টিনজাত খাবার বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। ভালো মানের ফিল্টারের পানি পান করা উচিত।
* লেখক: অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম | চিফ কনসালট্যান্ট, ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা