মালেক সাহেব আর শরিফা বেগমের সময় যেন কাটতেই চায় না।এক সময় তাদের বাড়িও লোক জনে পরিপূর্ণ থাকতো। কত রকম রান্না বান্না হতো! দুই ছেলের বন্ধু বান্ধবে বাড়ি সব সময় সরগরম থাকতো।মালেক শরিফা দম্পত্তির দু'টি ছেলে।বড় জন ইন্জিনিয়ার। বর্তমানে পরিবার নিয়ে থাকে কানাডায়।ছোট জন ডাক্তার। সেও পরিবার নিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়।দু'ছেলেই বিদেশে থাকার পাকা পোক্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছে।আগে প্রতি বছর ছেলেরা দেশে মা বাবাকে দেখতে আসলেও এখন আর আসতে পারে না বা আসতে চায় না বললেই চলে। বড় ছেলে সজল বউ নিয়ে কানাডায় গিয়েছে আজ এগারো বছর হলো। ছোট ছেলে কাজল সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ায় আছে আজ প্রায় সাত বছর।
মালেক শরিফা দম্পত্তির দিন শুরু হয় ফজরের নামাজ পড়ে।তারপর দু'জন এক সাথে হাটতে বের হয়।বৃদ্ধ বয়সে যে সব অসুখ সাধারণতঃ হয় তার সব গুলোই ধরেছে দু'জনকে।সাত সকালে দু'জন মানুষকে হাটতে দেখে এলাকার অনেকেই বলে ঐযে দুটি সুখি মানুষ! ইন্জিনিয়ার ডাক্তারের মা বাবা। কথাগুলো যদি কানে আসে মালেক সাহেব আর শরিফা বেগমের তবে তারা মুখটা একটু হাসি হাসি করার চেষ্টা করেন।কিন্তু হাসতে পারে না। দু'জনেরই যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
মালেক সাহেব এক সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। শরিফা বেগম বরাবরই গৃহিনী। একজনের বয়স বাহাত্তর আরেক জনের ছেষট্টি।মালেক সাহেবের এলাকায় উনি প্রফেসর দাদু নামে পরিচিত। আর শরিফা বেগমকে সবায় দাদী বলেই ডাকে। দু'জন কাজের মেয়ে আর ড্রাইভারকে নিয়ে তাদের বর্তমান সংসার। টাকা পয়সার কোন অভাবই নেই মালেক প্রফেসরের।
ইদানিং মালেক সাহেবের শরীরটা একটুও ভালো যাচ্ছে না। দুই ছেলেকে তাদের বাবার শারীরিক অবস্থার কথা জানানো হয়েছে। বড় ছেলে সজল কাজের লোকেদের ফোনে ভিডিও কল দিয়ে বাবার সাথে কথা বলছে, বাবাকে সাহস ও দিচ্ছে। বারবার সজল বলছে,
-কিচ্ছু হবে না বাবা, তুমি ঠিক হয়ে যাবে। স্বুস্থ হয়ে যাবে।এইতো আমরা আছি বাবা তোমার দু'ছেলে! আমি আছি, কাজল আছে।তোমার টেনশন কিসের? প্রায় দিনই তো তোমাদের সাথে দেখা হচ্ছে কথা হচ্ছে হোয়াটসআ্যাপে।
মালেক সাহেব চোখ খুলতেই পারছেন না। শরীর আর মনের যন্ত্রনায় দুটি চোখ উনি বুঁজে আছেন। উনার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাঁর যে খুবই সন্তানদেরকে কাছে পেতে মন চাইছে। দুই ছেলেকে বড্ড ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। বুকে যে তাঁর অসহ্য যন্ত্রনা! এদিকে সজল বলেই চলেছে,
-বাংলাদেশের সাথে সময়ের হের ফেরে হয়তো সেভাবে কথা হয় না, কিন্তু তুমি টেনশন করো না বাবা আমরা আছি তো!
শরিফা ছেলের কথা শোনে আর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে।
এ যাত্রায় মালেক সাহেব স্বুস্থ হয়ে উঠলেন। তাঁর হার্টের সমস্যা আজ ১১ বছর যাবত। রিং পরানো হয়েছে বছর সাতেক আগে। এরই সাথে আছে সুগার প্রবলেম হাই ব্লাড প্রেশারও। ইদানিং বড্ড শ্বাসকষ্ট ও হচ্ছে তাঁর। শরীফাও নানান রোগের রোগী। এই দু'টি বয়স্ক মানুষের রাত বিরাতে কোন অসুখ বিসুখ করলে প্রতিবেশিরা আগে ছুটে আসেন। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার কাজও তারা করেন। কিন্তু কতদিন মানুষ নিজের সংসার ফেলে উনাদেরকে দেখবে? পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই আক্ষেপ করে বলে,
-কি লাভ হলো দু'ছেলেকে ইন্জিনিয়ার ডাক্তার বানিয়ে? আবার এমনই সন্তান এরা যে, মা বাবাকে দেখতেও আসে না।
প্রতিবেশিরা নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করে এসব কথা। অনেকে আবার মনেও করতে পারে না শেষ কবে দেশে এসেছিলো সজল কাজল! এদিকে মালেক সাহেব ইদানিং প্রায় সময় স্ত্রীকে বলেন,
-আমি মারা গেলে, তুমি একা কি করে থাকবা? তোমার ছেলেরা তো আসবে না দেশে। তুমি কার কাছে থাকবা?
-চুপ করেন তো আপনি। সব সময় উল্টা পাল্টা কথা বলেন কেন?
শরীফা বেগম স্বামীকে ধমকে উঠেন।
গত রাতে স্বামীর অমন কথায় শরীফার একটুও ঘুম হয়নি।এমনিতেই তার ঘুম কম হয়। রাতে ঘুম না আসলে শরীফা বিছানায় বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করেন। কিন্তু গত রাতে কোরআন ও পড়েননি। বার বার স্বামীর কথাটাই মনে হচ্ছে। সত্যি তো! একা থাকা খুব কষ্টের! ছেলেরাও তো আসবে না। অবশ্য ছেলেরা বেড়াতে যেতে বলে তাদের কাছে। কিন্তু এই বয়সে লম্বা জার্নি করতে পারবে না বলেই ছেলেদের দেশে যাওয়া হয় না। রাজ্যের ঔষধ খেয়ে চলাফেরা করতে হয় শরীফা বেগমকে।
শরীফার শরীরটা আজ কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। ফজরের আজান এই মাত্রই শেষ হয়েছে। শরীফা বাথরুমে ওজু করতে যেয়েই মাথা ঘুরে ধড়াম করে পড়ে গেলেন। ড্রাইভার ছেলেটাকে কাজের মেয়েরা চিৎকার করে ডাকলেও তা যেন ছেলেটার কানেই পৌঁছাচ্ছে না। ড্রাইভারকে ছাদের উপর একটা ঘর করে দেওয়া হয়েছে, সেখানেই থাকে সে।বৌ বাচ্চা দেশের বাড়িতে থাকে ওর।
এক্সরে করে দেখা গেলো শরিফার কোমরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছে।এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ! ছেলেদের কানে কথাটা যাওয়া মাত্রই তারাও বিচলিত হয়ে ফোন করলো বাসায়। মা ছেলে মিলে অনেক কান্না কাটিও করলো তারা। শরীফা বেগম ছোট ছেলেকে বললো,
-বাবারে আমাদেরকে একটিবার দেখতে এসো। খুব কষ্টে আছি আমরা।
কাজল মা'কে জানালো,
-দেশে যাওয়া বললেই তো যাওয়া হয় না মা। তবে আমারো মনটা খুব ছটফট করছে তোমাদের জন্য।আমি বাড়ি আসবো। তোমার বউমা নাতিরা হয়তো আসতে পারবে না। কিন্তু আমি আসবো মা।
এত কষ্টের মাঝেও শরীফার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার খোকা যে বাড়ি আসবে! ছোট খোকা!
শরীফা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবেন এই তো সেদিনের কথা! দু'ছেলেকে নিয়ে কত দৌড়াদৌড়ি ছুটাছটি করেছে সে।বরাবরাই লেখাপড়ায় ভালো ছিলো দু'ছেলে। সজল কাজলের বাবাই তো বলতেন, লেখাপড়া মন দিয়ে করো। আমার থেকেও বড় হও। প্রয়োজনে ডিগ্রী নিতে বিদেশ যেতে হবে। আর তাই আজ দু'ছেলেই বিদেশে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শরীফার দু'চোখ ছলছল করে ওঠে। শরীরের কষ্ট, মনের কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ওদিকে কোমরের ব্যথা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে।
মালেক সাহেব সকালে আর হাঁটতে যান না। একা একা হাটতে যেতে সাহসও পান না। এদিকে উনার সুগারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। ইনসুলিন আগেও নিতেন এখন আবার দু'বেলা নিতে হচ্ছে। কাজের মেয়ে দুটি যথেষ্টই দেখাশোনা করে মালেক সাহেব আর শরীফাকে। কিন্তু এই বয়সে এসে শুধু যে কাজের লোকের ভালোবাসা না, সন্তানদের ভালোবাসা পেতেও মন চায়। খুব মন চায়, ছেলে দু'টিকে যদি আর একটি বার এক সাথে দেখতে পেতাম!
মাঝে মাঝে শরীফা বেগম ভাবেন, "ইশ্! একটি ছেলে যদি দেশে থাকতো! তবে প্রতিদিন না হোক মাসে একবার তো আসতো বাবা মা'কে দেখতে।"
"ছিঃ ছিঃ এসব কথা আমি ভাবছি কেন?" নিজের মনে মনেই বলেন শরীফা বেগম।আমরাই তো শিখিয়েছি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে।দেশ বিদেশে সন্তানের নাম ছড়িয়ে পড়ুক, সেই দোয়ায় তো করেছি আল্লাহর কাছে। আর আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুলও করেছেন।"
শরীফা আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করেন।আর দোয়া করতেই থাকেন দু'ছেলের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য।
মালেক সাহেবের জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছে।কি ভাবে কখন কি হলো কেউ বলতে পারছে না। সকালে ড্রাইভার বেতন নিতে মালেক সাহেবের রুমে যেয়ে দেখে উনি মেঝেতে পড়ে আছেন।অবশ্য মালেক সাহেবের বিছানা একটা শক্ত জাজিম দিয়ে মেঝেতেই পাতা।ড্রাইভারের বিকট একটা চিৎকারে আশে পাশের লোকজন আসতে শুরু করেছে " অতিথী" নামের বাড়িটিতে।দ্রুত পাড়ার ডাক্তারও আনা হলো বাসায়। ডাক্তার জানালেন,
-উনি বেঁচে নেই।রাতের কোন এক সময় হয়তো মারা গিয়েছেন উনি।
শরীফা বেগম দিশেহারা। বিছানা থেকে ওঠার শক্তি নেই তার। শুধু দু'চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ছেলে দু'টোর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। জোরে জোরে বলতে ইচ্ছা করছে বড় খোকা ছোট খোকা তোরা আয়, দেখে যা শেষবাবের মত তোদের বাবাকে।শরীফা বেগম বিছানায় শুয়ে শুয়েই স্বামীর জন্য দোয়া কালমা পড়ছেন। দেশের বাড়ি থেকে আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে।অনেকেই বলছেন,
-ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করে কি হবে? বাদ আসর দাফন করা হোক। অবশ্য শরীফারও তেমনই ইচ্ছা।
হঠাৎ শরীফার কানে আসলো কিছু লোকজনের কথা।কারা যেন বলছে,
"শুনেছি প্রফেসরের ছোট ছেলে কাজল নাকি মস্ত বড় ডাক্তার!! তা সেই ছেলের বাবাকে এভাবে মরতে হলো!"
কথাটি শুনে শরীফার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে।
শরীফা বেগম জানেন জীবন চক্রাকারে এমন ভাবেই ঘুরছে, যা কারো জন্য একটি মুহূর্তও থেমে থাকে না।
(সমাপ্ত)
মালেক শরিফা দম্পত্তির দিন শুরু হয় ফজরের নামাজ পড়ে।তারপর দু'জন এক সাথে হাটতে বের হয়।বৃদ্ধ বয়সে যে সব অসুখ সাধারণতঃ হয় তার সব গুলোই ধরেছে দু'জনকে।সাত সকালে দু'জন মানুষকে হাটতে দেখে এলাকার অনেকেই বলে ঐযে দুটি সুখি মানুষ! ইন্জিনিয়ার ডাক্তারের মা বাবা। কথাগুলো যদি কানে আসে মালেক সাহেব আর শরিফা বেগমের তবে তারা মুখটা একটু হাসি হাসি করার চেষ্টা করেন।কিন্তু হাসতে পারে না। দু'জনেরই যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
মালেক সাহেব এক সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। শরিফা বেগম বরাবরই গৃহিনী। একজনের বয়স বাহাত্তর আরেক জনের ছেষট্টি।মালেক সাহেবের এলাকায় উনি প্রফেসর দাদু নামে পরিচিত। আর শরিফা বেগমকে সবায় দাদী বলেই ডাকে। দু'জন কাজের মেয়ে আর ড্রাইভারকে নিয়ে তাদের বর্তমান সংসার। টাকা পয়সার কোন অভাবই নেই মালেক প্রফেসরের।
ইদানিং মালেক সাহেবের শরীরটা একটুও ভালো যাচ্ছে না। দুই ছেলেকে তাদের বাবার শারীরিক অবস্থার কথা জানানো হয়েছে। বড় ছেলে সজল কাজের লোকেদের ফোনে ভিডিও কল দিয়ে বাবার সাথে কথা বলছে, বাবাকে সাহস ও দিচ্ছে। বারবার সজল বলছে,
-কিচ্ছু হবে না বাবা, তুমি ঠিক হয়ে যাবে। স্বুস্থ হয়ে যাবে।এইতো আমরা আছি বাবা তোমার দু'ছেলে! আমি আছি, কাজল আছে।তোমার টেনশন কিসের? প্রায় দিনই তো তোমাদের সাথে দেখা হচ্ছে কথা হচ্ছে হোয়াটসআ্যাপে।
মালেক সাহেব চোখ খুলতেই পারছেন না। শরীর আর মনের যন্ত্রনায় দুটি চোখ উনি বুঁজে আছেন। উনার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাঁর যে খুবই সন্তানদেরকে কাছে পেতে মন চাইছে। দুই ছেলেকে বড্ড ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। বুকে যে তাঁর অসহ্য যন্ত্রনা! এদিকে সজল বলেই চলেছে,
-বাংলাদেশের সাথে সময়ের হের ফেরে হয়তো সেভাবে কথা হয় না, কিন্তু তুমি টেনশন করো না বাবা আমরা আছি তো!
শরিফা ছেলের কথা শোনে আর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে।
এ যাত্রায় মালেক সাহেব স্বুস্থ হয়ে উঠলেন। তাঁর হার্টের সমস্যা আজ ১১ বছর যাবত। রিং পরানো হয়েছে বছর সাতেক আগে। এরই সাথে আছে সুগার প্রবলেম হাই ব্লাড প্রেশারও। ইদানিং বড্ড শ্বাসকষ্ট ও হচ্ছে তাঁর। শরীফাও নানান রোগের রোগী। এই দু'টি বয়স্ক মানুষের রাত বিরাতে কোন অসুখ বিসুখ করলে প্রতিবেশিরা আগে ছুটে আসেন। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার কাজও তারা করেন। কিন্তু কতদিন মানুষ নিজের সংসার ফেলে উনাদেরকে দেখবে? পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই আক্ষেপ করে বলে,
-কি লাভ হলো দু'ছেলেকে ইন্জিনিয়ার ডাক্তার বানিয়ে? আবার এমনই সন্তান এরা যে, মা বাবাকে দেখতেও আসে না।
প্রতিবেশিরা নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করে এসব কথা। অনেকে আবার মনেও করতে পারে না শেষ কবে দেশে এসেছিলো সজল কাজল! এদিকে মালেক সাহেব ইদানিং প্রায় সময় স্ত্রীকে বলেন,
-আমি মারা গেলে, তুমি একা কি করে থাকবা? তোমার ছেলেরা তো আসবে না দেশে। তুমি কার কাছে থাকবা?
-চুপ করেন তো আপনি। সব সময় উল্টা পাল্টা কথা বলেন কেন?
শরীফা বেগম স্বামীকে ধমকে উঠেন।
গত রাতে স্বামীর অমন কথায় শরীফার একটুও ঘুম হয়নি।এমনিতেই তার ঘুম কম হয়। রাতে ঘুম না আসলে শরীফা বিছানায় বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করেন। কিন্তু গত রাতে কোরআন ও পড়েননি। বার বার স্বামীর কথাটাই মনে হচ্ছে। সত্যি তো! একা থাকা খুব কষ্টের! ছেলেরাও তো আসবে না। অবশ্য ছেলেরা বেড়াতে যেতে বলে তাদের কাছে। কিন্তু এই বয়সে লম্বা জার্নি করতে পারবে না বলেই ছেলেদের দেশে যাওয়া হয় না। রাজ্যের ঔষধ খেয়ে চলাফেরা করতে হয় শরীফা বেগমকে।
শরীফার শরীরটা আজ কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। ফজরের আজান এই মাত্রই শেষ হয়েছে। শরীফা বাথরুমে ওজু করতে যেয়েই মাথা ঘুরে ধড়াম করে পড়ে গেলেন। ড্রাইভার ছেলেটাকে কাজের মেয়েরা চিৎকার করে ডাকলেও তা যেন ছেলেটার কানেই পৌঁছাচ্ছে না। ড্রাইভারকে ছাদের উপর একটা ঘর করে দেওয়া হয়েছে, সেখানেই থাকে সে।বৌ বাচ্চা দেশের বাড়িতে থাকে ওর।
এক্সরে করে দেখা গেলো শরিফার কোমরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছে।এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ! ছেলেদের কানে কথাটা যাওয়া মাত্রই তারাও বিচলিত হয়ে ফোন করলো বাসায়। মা ছেলে মিলে অনেক কান্না কাটিও করলো তারা। শরীফা বেগম ছোট ছেলেকে বললো,
-বাবারে আমাদেরকে একটিবার দেখতে এসো। খুব কষ্টে আছি আমরা।
কাজল মা'কে জানালো,
-দেশে যাওয়া বললেই তো যাওয়া হয় না মা। তবে আমারো মনটা খুব ছটফট করছে তোমাদের জন্য।আমি বাড়ি আসবো। তোমার বউমা নাতিরা হয়তো আসতে পারবে না। কিন্তু আমি আসবো মা।
এত কষ্টের মাঝেও শরীফার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার খোকা যে বাড়ি আসবে! ছোট খোকা!
শরীফা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবেন এই তো সেদিনের কথা! দু'ছেলেকে নিয়ে কত দৌড়াদৌড়ি ছুটাছটি করেছে সে।বরাবরাই লেখাপড়ায় ভালো ছিলো দু'ছেলে। সজল কাজলের বাবাই তো বলতেন, লেখাপড়া মন দিয়ে করো। আমার থেকেও বড় হও। প্রয়োজনে ডিগ্রী নিতে বিদেশ যেতে হবে। আর তাই আজ দু'ছেলেই বিদেশে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শরীফার দু'চোখ ছলছল করে ওঠে। শরীরের কষ্ট, মনের কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ওদিকে কোমরের ব্যথা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে।
মালেক সাহেব সকালে আর হাঁটতে যান না। একা একা হাটতে যেতে সাহসও পান না। এদিকে উনার সুগারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। ইনসুলিন আগেও নিতেন এখন আবার দু'বেলা নিতে হচ্ছে। কাজের মেয়ে দুটি যথেষ্টই দেখাশোনা করে মালেক সাহেব আর শরীফাকে। কিন্তু এই বয়সে এসে শুধু যে কাজের লোকের ভালোবাসা না, সন্তানদের ভালোবাসা পেতেও মন চায়। খুব মন চায়, ছেলে দু'টিকে যদি আর একটি বার এক সাথে দেখতে পেতাম!
মাঝে মাঝে শরীফা বেগম ভাবেন, "ইশ্! একটি ছেলে যদি দেশে থাকতো! তবে প্রতিদিন না হোক মাসে একবার তো আসতো বাবা মা'কে দেখতে।"
"ছিঃ ছিঃ এসব কথা আমি ভাবছি কেন?" নিজের মনে মনেই বলেন শরীফা বেগম।আমরাই তো শিখিয়েছি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে।দেশ বিদেশে সন্তানের নাম ছড়িয়ে পড়ুক, সেই দোয়ায় তো করেছি আল্লাহর কাছে। আর আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুলও করেছেন।"
শরীফা আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করেন।আর দোয়া করতেই থাকেন দু'ছেলের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য।
মালেক সাহেবের জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছে।কি ভাবে কখন কি হলো কেউ বলতে পারছে না। সকালে ড্রাইভার বেতন নিতে মালেক সাহেবের রুমে যেয়ে দেখে উনি মেঝেতে পড়ে আছেন।অবশ্য মালেক সাহেবের বিছানা একটা শক্ত জাজিম দিয়ে মেঝেতেই পাতা।ড্রাইভারের বিকট একটা চিৎকারে আশে পাশের লোকজন আসতে শুরু করেছে " অতিথী" নামের বাড়িটিতে।দ্রুত পাড়ার ডাক্তারও আনা হলো বাসায়। ডাক্তার জানালেন,
-উনি বেঁচে নেই।রাতের কোন এক সময় হয়তো মারা গিয়েছেন উনি।
শরীফা বেগম দিশেহারা। বিছানা থেকে ওঠার শক্তি নেই তার। শুধু দু'চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ছেলে দু'টোর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। জোরে জোরে বলতে ইচ্ছা করছে বড় খোকা ছোট খোকা তোরা আয়, দেখে যা শেষবাবের মত তোদের বাবাকে।শরীফা বেগম বিছানায় শুয়ে শুয়েই স্বামীর জন্য দোয়া কালমা পড়ছেন। দেশের বাড়ি থেকে আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে।অনেকেই বলছেন,
-ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করে কি হবে? বাদ আসর দাফন করা হোক। অবশ্য শরীফারও তেমনই ইচ্ছা।
হঠাৎ শরীফার কানে আসলো কিছু লোকজনের কথা।কারা যেন বলছে,
"শুনেছি প্রফেসরের ছোট ছেলে কাজল নাকি মস্ত বড় ডাক্তার!! তা সেই ছেলের বাবাকে এভাবে মরতে হলো!"
কথাটি শুনে শরীফার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে।
শরীফা বেগম জানেন জীবন চক্রাকারে এমন ভাবেই ঘুরছে, যা কারো জন্য একটি মুহূর্তও থেমে থাকে না।
(সমাপ্ত)